একজন মানুষের জীবনে বহু রকম ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে দুুটি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে, তারপর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এ দুটি ঘটনা চিরন্তন। এ দুটি ঘটনা শুধু মানুষের বেলায় ঘটে তা নয়, পৃথিবীর তাবৎ প্রাণি গাছপালা এমন কি বস্তুর ক্ষেত্রেও ঘটে চলেছে এবং ঘটতে বাধ্য। যার সৃষ্টি আছে তার ধ্বংসও আছে।
মানুষ সুখে হাসে দুঃখে কাঁদে। মানবসন্তান সন্তান যখন ভূমিষ্ট হয় তখন সে কান্না দিয়ে জানান দেয়, পৃথিবীতে তার আগমন ঘটেছে। এই আসার সংকেত পেয়ে প্রসববেদনায় কাতর মা সব কষ্ট ভুলে গিয়ে হাসি মুখে সন্তানকে বুকে তুলে নেয়, পাশাপাশি অন্যরাও সে আনন্দের ভাগীদার হয়। এ অানন্দকে পুঁজি করে জন্ম নেয়া মানবসন্তান ধীরে ধীরে অনেক কিছু ঘটিয়ে চলে। যেসব ঘটনা সে ঘটায় তার আবার দু রকম দিক আছে, একটি ইতিবাচক, অপরটি নেতিবাচক, অর্থাৎ ভালো এবং মন্দ। যে যেটাই ঘটিয়ে তুলুক, দুটোই বিষয়ই সম্ভাবিত হয় সে জন্ম নেয় বলে। সুতরাং পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্ম নিয়ে সে পৃথিবীতে একটা ইতিহাস তৈরি করে, কারওটা মনে রাখার মতো কারওটা মনে রাখার মতো হয়ে ওঠে না। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ এসেছে, আবার তারা প্রকৃতির নিয়মে চলেও গেছে। এত মানুষ এল গেল, কিন্তু খুব কম মানুষই ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে যাদের নাম পৃথিবীতে সম্মানের সঙ্গে হোক আর অসম্মানের সঙ্গে অদ্যাবধি টিকে আছে। এই টিকে থাকা মানুষগুলোই হল ইতিহাসের নায়ক। তাহলে কি বাকিরা কি ইতিহাসের চরিত্র ছিল না? ছিল, কিন্তু মানুষ তাদের মনে রাখেনি। সুতরাং মানুষের চলে যাওয়াটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়। চলে যাওয়া মানুষের কোন দাম নেই। তবে সে যে কিছু কাজ কিংবা কিছু কাজের গতি রেখে যায় তার জন্য মানুষ অদৃশ্যভাবে বেঁচে থাকে। এজন্য মানুষ তাকে স্মরণ করে। এ অদৃশ্যভাবে বেঁচে থাকা এবং তার জীবন ও কাজকে স্মরণ করা সেটি মৃত মানুষের জন্মেরই ফল। জন্ম মানে আনন্দ, মৃত্যু সে আনন্দের ইতি ঘটায়, যদিও আনন্দের কিছু রেশ থেকে যায়।
মৃত্যু মানে জীবনের শেষ সীমারেখা। এই সীমারেখোর বাইরে তার কিছু করার থাকে না। কিন্তু মজার বিষয় হল মানুষ মারা গেলে জন্মদিনের চে মৃত্যুর দিনকে বেশি ঘটা করে পালন করে। মানুষ যেমন কষ্টের গান, কষ্টের কবিতা, কষ্টের সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলতে পছন্দ করে তেমনি মৃত মানুষের জন্য শোক প্রকাশ করেও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমরা যাই করি না কেন, তার পেছনে কিন্তু জন্ম। ফলে আমি যেকারও জন্মদিন তার মৃত্যুদিনের চে বেশি করে উপভোগ করি। কি লিখতে গিয়ে কি লিখছি নিজেও জানি না। বোধহয় কিছুটা অহেতুক বাজে পাণ্ডিত্য জাহির করে ফেললাম।
আজ ৩০ জুন। যারা সাহিত্য করেন, সাহিত্য পড়েন, যারা আহমদ ছফাকে ভালোবাসেন তাদের কাছে এ দিনটির প্রতি খানেকটা দরদ আছে বৈকি। সাহিত্যের রাজকুমার মনীষী লেখক আহমদ ছফা এই দিনে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মেছিলেন। কাগজে কলমে সালটি ছিল ১৯৪৩। সে হিসেবে তিনি বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স দাঁড়াত ৭৮ বছর। কিন্তু আহমদ ছফার হিসেবে তাঁর জন্ম আরও এক বছর আগে। স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় তাঁর শিক্ষকেরা বয়স এক বছর কমিয়ে দিয়েছিলেন। সেটি ধর্তব্যে নিলে আজ আহমদ ছফা ৭৯ বছর বয়সী হতেন। তথ্যের খাতিরে এসব বলা। কাগজে কলমে যেটি সেটিকে হিসেবে নিলে আজ আহমদ ছফার ৭৮তম জন্মবার্ষিকী।
আহমদ ছফার কথা এলে কতকিছুই তো মনে পড়ে। সবসময় তিনি একটু ব্যতিক্রমধর্মী পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। কোন কাপড় তাঁকে এক মাসের বেশি পরতে দেখা যেত না। কিছুদিন পরার পর সে কাপড় তিনি অন্যকাউকে দিয়ে দিতেন। তাঁর গায়ের অনেক কাপড় পরার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এখনও তাঁর দেয়া কাপড় মাঝে মাঝে পরে আমি অতীতে ফিরে যাই। ব্যতিক্রমধর্মী ছিল তাঁর কথাবার্তা, ব্যতিক্রম ছিল চলাফেরা। অন্য দশজনের সঙ্গে তাঁকে মেলানো যেত না। তাঁর চোখ মুখ একসঙ্গে কথা বলত। যখন তিনি রেগে যেতেন কিংবা বিরক্তিবোধ করতেন তখন ঠোঁটকে সূঁচালো করে ফেলতেন। কখনও কখনও চোখের চাহনি পাল্টে দিতেন, কিংবা ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তির চরম প্রকাশ ঘটাতেন। কোনকিছু পছন্দ না হলে শিস দিয়ে তা উড়িয়ে দিতেন। কারও কথায় কাজে অসঙ্গতি দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম আহমদ ছফায় পরিণত হতেন। অহংকার করার মতো তাঁর অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু অহংকারী ছিলেন না। সবসময় নিজেকে একজন তুচ্ছ মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেন, কখনও নিজেকে বড় করে দেখাতেন না।
হারমোনিয়ামটাও তাঁর অনুসঙ্গ ছিল। পড়ার টেবিল থেকে উঠে তিনি কিছুক্ষণ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। অসুখ বিসুখ, মন খারাপের সময়ও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে মনকে হালকা করার চেষ্টা করতেন।
শরীরে নানারকম অসুখ বাসা বেঁধেছিল। হাঁপানি, পাইলস, অ্যাকজিমা, ডায়াবেটিস, দাঁতের ব্যথা প্রায় লেগে থাকত। কখনও তাঁকে অসুস্থতার নাম করে শুয়ে থাকা কিংবা কাজকে এড়িয়ে যেতে দেখিনি। অসুস্থতা নিয়ে কখনও হাহুতাশও করতেন না। তিনি যে অসুস্থ তা কারও কাছে প্রকাশ করাও ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছেন?
তাঁকে অন্যকারও সঙ্গে মেলানো দুষ্কর। একেবারে স্বতন্ত্র একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর কথা বলার ধরন, চলাফেরা, পোশাকপরিচ্ছদ, চিন্তাচেতনা সবকিছু তিনি নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছিলেন। সব ধরনের গান তিনি একই সুরে গাইতেন, এমন কি কোরান পাঠও। কোনকিছুকে তিনি হেলা করে দেখতেন না। যা করতেন সবকিছুকে তিনি কাজ হিসেবে নিতেন এবং দায়িত্বের অংশ মনে করতেন। সবসময় মাথায় নানাচিন্তা কাজ করত বলে তাঁর ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করত। আবার ধৈর্য্যশক্তিও ছিল অসাধারণ। একটা কাজের পেছনে দীর্ঘদিন শ্রমসাধনা করে শেষ দেখার চেষ্টায় তিনি বিভোর থাকতেন।
চাকরি তিনি কখনও করেননি। চাকরিকে খুব ভয় পেতেন। হুকুম মেনে কাজ করা তাঁর ধাঁতে ছিল না। খাই না খাই স্বাধীন থাকতে পছন্দ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করার একটা সম্ভাবনা হয়তো দেখা দিয়েছিল। বোধকরি সেটি তাঁর পছন্দও ছিল। পছন্দ ছিল বলছি এ কারণে, আমার বয়স তখন অল্প। তিনি আমার বড় ভাইকে একখানা চিঠিতে লিখেছিলেন, আমি ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে চলেছি। কিন্তু কেন সেটি হয়নি তা জানা যায়নি।
না পাওয়ার বেদনায় তিনি কখনও হতাশ হতেন না। হিংসা, নিষ্ঠুরতা, প্রতিশোধ পরায়নতা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে একেবারে বেমানান ছিল। জীবনে নানারকম অত্যাচার এবং প্রতারণার শিকার তিনি হয়েছেন, তা নিয়ে তাঁকে কখনও টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি পর্যায়ে যখনই কোনরকম অসঙ্গতি কিংবা নষ্টামি চোখে পড়েছে তখনই দেখা গেছে আহমদ ছফাকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে। কাজটি তাঁর জন্য সহজ ছিল না। এসব করতে গিয়ে ব্যক্তিজীবনেও তিনি সুখী হতে পারেননি, তাঁকে পড়তে হয়েছে নানা রোষানলে। নিজের ক্ষতি হবে জেনেও তিনি কখনও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এ বিচ্যুত না হওয়ার পেছনে ছিল তাঁর সাহসী মনোভাব। এ সাহসকে পুঁজি করে তিনি আজীবন পথ চলেছেন। মুক্তধারার বইয়ের ক্যাটালগে অনেক আগে একটা লেখা পড়েছিলাম, "সত্যকে গোপন করা এবং মিথ্যাকে ঢেকে রাখা আহমদ ছফার স্বভাব নয়।' আমার কেন জানি মনে হয়, সত্যকে ধারণ করে মিথ্যার বিরুদ্ধে আঙুল তুলে কথা বলার অর্থ আহমদ ছফা।
No comments:
Post a Comment