কাজী নজরুল ইসলামের সৎ সমালোচকের খোঁজে / নজরুল সাহিত্য সমালোচনা


লিখেছেন: সীমান্ত কুমার সিং 


নজরুল সম্পর্কে খুব ছোট থেকেই বেশ কৌতূহলী ছিলাম। হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে অনেক পরে জেনেছি। গ্ৰন্থাগারে একসময় সব থেকে বেশি যাঁর বই অধ্যয়ন করতাম তিনি হলেন নজরুল। তাঁর কিছু লেখা পড়ে মনে হতো তিনি একজন মহানুভব; আবার কিছু লেখা পড়ে মনে হতো চরম মাত্রায় ধূর্ত। যাই হোক, তখন বাস্তব সত্য পুরোপুরি জানতে পারি নি। পরবর্তীতে বহু অনুসন্ধানের পর নজরুলের প্রকৃত সত্য উপলব্ধিকারী সত্যান্বেষী ব্যক্তির সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম। তিনি হলেন মুক্তচিন্তক ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ। নজরুল সাহিত্যের সব থেকে বেশি যুক্তিসংগত সমালোচনা তিনিই করতেন।

হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘আমার অবিশ্বাস’ বইয়ের ৪০ ও ৪১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- 
"তরুণ বয়স থেকেই অস্বস্তি বোধ করি আমি নজরুলের লেখা পড়ার সময়; তিনি মাঝারি লেখক ব'লে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত লেখক ব'লে। প্রচারে প্রচারে তাঁকে আমি বিদ্রোহী বলেই মনে করেছি যখন বালক ছিলাম, বেশ কিছু পদ্যেগদ্যে দেখেছিও তাঁর বিদ্রোহীরূপ, কিন্তু তিনি বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান। বেশি ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি।

গানের পরে গানে তিনি লিখেছেন নামাজ পড়, রােজা রাখ, কলমা পড় ভাই। তাের আখেরের কাজ করে নে, সময় যে আর নাই’; ‘শােননা শােনাে য়্যা এলাহি আমার মুনাজাত। / তােমারি নাম জপে যেন হৃদয় দিবস - রাত’ / ‘আল্লাহ নামের নায়ে চড়ে যাব মদিনায়’; মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেনাে গােরে থেকেও মােয়াজ্জিমের আজান শুনতে পাই’; ‘ওরে ও দরিয়ার মাঝি। মােরে নিয়ে যা রে মদিনা’; ‘খােদার প্রেমের শারাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পড়ে’; ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়/আমার নবী মােহাম্মদ, যাহার তারিফ জগতময়। অবশ্য এগুলােকেও অনেকে মনে করতে পারেন খুবই বিদ্রোহী ও প্রগতিশীল কাণ্ড; কিন্তু এখানে কোনাে বিদ্রোহীকে পাচ্ছি না, পাচ্ছি একজন ইসলাম অন্ধকে। নজরুলের বিশ্বাসও সন্দেহজনক, মনে হয় তিনি এক বিশ্বাসের সাথে আরেক বিশ্বাসের পার্থক্য বােঝেন না। বিধিবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসগুলাে কঠোর, একটি মানলে আরেকটি মানা যায় না, ইসলাম মানলে হিন্দুধর্ম মানা যায় না। একই সাথে কেউ হতে পারে না মুসলমান ও হিন্দু; কিন্তু নজরুল তাঁর এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে। আমি বিস্মিত হই। যিনি লেখেন আল্লাহ্ আমার প্রভু, নাহি নাহি ভয়/ আমার নবী মােহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগতময়’, তিনি কী করে লিখতে পারেন কালী কালী মন্ত্র জপি বসে লােকের ঘাের শ্মশানে’; বল্ রে জবা বল্ কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল’; ‘তাের রাঙা পায়ে নে মা শ্যামা আমার প্রথম পূজার ফুল ও আরাে এমন বহু পৌত্তলিক পদ। তিনি কি একই সাথে হতে পারেন খাঁটি মুসলমান, আর কালীভক্ত? অনেকে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন যে নজরুল দুই সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়েছিলেন; যদি তিনি তাই করে থাকেন তাহলে তিনি মিলন ঘটিয়েছিলেন দুই খারাপের। আমি কি এমন মিলন ঘটাতে পারি? আমি কি আজ আল্লাহর স্তব লিখে কাল কালীমায়ের পায়ে সঁপতে পারি নিজেকে? নজরুলের কি কোনাে বিশ্বাস ছিলাে? না কি তিনি স্বতস্ফূর্ত উদ্গীরণ করেছেন বিদ্রোহ; আর বাণিজ্যিক প্রেরণায় লিখে গেছেন একই সাথে হামদ, নাত, আর কালীকীর্তন? নজরুলের ইসলামি আর শাক্ত গানগুলাে তাঁকে প্রচুর অর্থ এনে দিয়েছিলাে। আর ওই অর্থই হয়তাে তাঁকে মাতিয়েছিলাে কুসংস্কৃত উদ্দীপনায়”।

এখানেই শেষ নয়। নারীদের প্রতি নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি জানলে সবাই চমকে উঠবে। নজরুল একবার তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছিলেন-
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি
চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,
অর্ধেক তার নর৷

এই নজরুলই আবার তাঁর ‘পূজারিণী’
কবিতায় লিখেছেন-
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো
এরা দেবী, এরা লোভী,
যত পূজা পায় এরা চায় আরো।
ইহাদের অতি লোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, 
এক পেয়ে খুশি নয়,
যাচে বহুজন।

এই হলো নজরুলের নিজ মতের বিরুদ্ধাচরণ।স্ববিরোধী নজরুলের ন্যায়সংগত সমালোচনা করার ফলে অনেক সুবিধাবাদী একসময় হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক লেখা লিখেছিল কিন্তু এতে হুমায়ুন আজাদের কিছু যায় আসে নি। কারণ, হুমায়ুন আজাদ সত্যনিষ্ঠ। নজরুলের সেই আলোচকদের নিয়ে তিনি তাঁর প্রবচনগুচ্ছে লিখেছিলেন - "নজরুলসাহিত্যের আলোচকেরা সমালোচক নন, তাঁরা নজরুলের মাজারের খাদেম"। সবশেষে বলতে চাই- হুমায়ুন আজাদ নজরুলকে নিয়ে যে সমালোচনা করেছেন সেটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং মানুষের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য যথেষ্ট।

No comments:

Post a Comment