নারীচরিত্র প্রধান গল্প আর নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা গল্প আলাদা বিষয় : মোজাফ্ফর হোসেন


নারীচরিত্র প্রধান গল্প উপন্যাস ও সিনেমা অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্প খুব বেশি পাওয়া যাবে না। হাজার বছর ধরে শিল্পসাহিত্যে নারী চরিত্র প্রধান গল্পটিও নির্মিতি হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। চিপিউয়া এলডাল বলছেন: অন্যকেউ আপনার গল্পের ভাষ্যকার হলে আপনার গল্পটি বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হবে। এই কারণে কানাডীয় নারীবাদী লেখক মারগারেট অ্যাটউডকে বলতে শুনি: আমি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্বাস করি না। আমি নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে চাই।

প্রশ্ন হলো: নারী হলেই কি নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প লেখা সম্ভব?

—সব সময় না। অনেক নারীও শিল্প সৃষ্টি করেন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। পুরুষের শিল্প-আদর্শ, পুরুষের শিল্পমান, পুরুষতান্ত্রিক ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নারীর গল্প কোনো নারী লিখলেও সেটা নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হলো না।

নারীরা এক অর্থে পুরুষের কলোনাইজড, আরেক অর্থে সাবঅলটার্ন। ফলে নারীকে দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজস্ব ন্যারেটিভ নির্মাণ করতে হচ্ছে। নতুন করে এখন নারীদের একটা সাহিত্যিক-ঐতিহ্য তৈরি করতে হচ্ছে। যে কারণে অস্ট্রেলিয়ান নারীবাদী লেখক ডেল স্পেনডার তার Mothers of the Novel বইতে বলছেন, …it is not necessary to invent a literary tradition for women, only to rewrite the records and to put in what men have left out. এই বইতে ডেল দেখাচ্ছেন যে, জেন অস্টিনের আগে উল্লেখ করার মতো একশজন নারী ঔপন্যাসিক এসেছেন। কিন্তু সাহিত্যের পৃষ্টপোশক পুরুষ হওয়ার কারণে এবং সাহিত্যের ইতিহাস পুরুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখার ফলে এ-সকল লেখক হারিয়ে গেছেন।

আমরা জানি, বাংলায় উনিশ শতকের শুরুতে নারীরা এখনকার মতো গদ্য লিখতেন না। তাঁরা বিভিন্ন সাময়িকীতে পত্রাকারে নিজের একান্ত অনুভূতির কথা লিখতেন। তাও অবশ্য সব কাগজে লিখতে পারতেন না। হিন্দু ‘ভদ্রজন’ দ্বারা সম্পাদিত কাগজে নারীরা লিখতে পারতেন না। ‘সমাচার-দর্পণ’-এ লিখতে পারতেন কারণ সেটি ছিল মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত। আর লিখতে পারতেন ‘সম্বাদ-কৌমুদী’তে, কারণ সেটির পেছনে ছিলেন রামমোহন রায়ের মতো প্রগ্রেসিভ ভারতীয়। ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায়ও লিখতে পারতেন। কয়েকটি লেখা (পত্র) প্রকাশিত হয়েছে সোমপ্রকাশেও। তবে সেসময় নারীদের লেখার আরেক যন্ত্রণা ছিল, স্বনামে তাঁরা লিখতে পারতেন না। নানা ছদ্মনামে লিখতেন। যে কারণে এখনো অনেক লেখার প্রকৃত লেখকের নাম বা পরিচয় পাওয়া যায় নি। সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁদের নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি।

কারণ স্পষ্ট: the language of literary history is man-made, and the order it imposes on the past a male construct. এই কারণে এখন একজন নারী লেখকের ভালো লেখাটাই কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, নারীদের নিজস্ব সাহিত্যের ট্রাডিশন তৈরিতে অবদান রাখতে পারাটাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ বটে। এই যে নারীদের স্বকীয় ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ছলে বলা হয় মেয়েদের গদ্য মেয়েলি। এবং মেয়েরাও চেষ্টা করেছেন এই মেয়েলি গদ্য থেকে বের হয়ে পুরুষ সমালোচকীয় দৃষ্টিতে উতরে যেতে। পুরুষের ভাষায় আমি লিখব কেন? এই প্রশ্ন কজন করতে পেরেছেন! সাহিত্যে ভাষা দুরকমের। ভাল এবং মন্দ। এটা শিল্পের বিচারে। কিন্তু জেন্ডার রাজনীতিতে শিল্পের ভাষা আরও দু ধরনের। পুরুষের ভাষা এবং নারীর ভাষা। নারীর গদ্যভাষার অনন্য আদর্শ হতে পারে ভার্জিনিয়া উলফ-কেট শপা-শার্লট পারকিনস গিলম্যান-উইলা ক্যাথার, ইসমত চুঘতাই-অমৃতা প্রীতম-মরিসন-রিজিয়া রহমান-মার্গারেট অ্যাটউড-সহ আরও অনেকে। নারীদের সাহিত্যভাষার সমস্যা হলো, ভাষাটা তৈরি না নানাদিক থেকে। যেমন, নারী লেখকদের নিজস্ব যৌনতার ভাষা এখনো তৈরি হয়নি। কারণ এখনো সাহিত্যে নায়িকার রূপের যে বর্ণনা থাকে, সেটা পুরুষের দেখা দৃষ্টিতে। পুরুষের ফ্যান্টাসি দিয়ে গড়া শিল্পের প্রেম ও যৌনতা। মধ্যযুগের সাহিত্যে আলাওল বা জায়সির কল্পনায় পদ্মাবতীর রূপটি কেমন?

সুচারু নিতম্ব অতি ধরে নিতম্বিনী।
করিবর কুম্ভ জিনি সুন্দর বলনি।
নাভি অধঃস্থলে পুনি ত্রিজ গমোহন।
উচিত কহিতে লাজ অকথ্যকথন।।

আধুনিক সাহিত্যে এসে ভাষাটা বদলেছে, দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটেনি। ফলে নায়িকার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দিতে তার গায়ের রঙ, বুক কেমন, সু নিতম্বিনী কিনা এগুলো উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করেন লেখক, কিন্তু নায়কের কোনো শারীরিক বর্ণনা আমরা পাই না। অধিকাংশ নারী লেখকও নায়িকার রূপের অনুরূপ বর্ণনা দেন কিন্তু পুরুষের শরীরের কোনো বিবরণ দেন না। এক্ষেত্রে এখনকার অনেক নারীলেখকের চেয়ে নওয়াব ফয়জুননেসা অনেক জেন্ডার-সচেতন ছিলেন। রূপজালাল যারা পড়েছেন তারা সেখানে নারীর দৃষ্টিতে পুরুষকে অনেকটা পাবেন।
মোটের উপর: সাহিত্যে 'মেয়েদের গদ্য মেয়েলি, এটা দুর্বল', এই ধরনের কথা বলা একটা জেন্ডার পলিটিক্স৷
ফলে, নারীচরিত্র প্রধান গল্প লেখা আর নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা আলাদা বিষয়। নারীচরিত্রপ্রধান গল্প পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা যেতে পারে। আবার, পুরুষরচরিত্রপ্রধান গল্পও নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা যেতে পারে। নারীলেখক পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখতে পারেন, আবার পুরুষ লেখক নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখতে পারেন।

No comments:

Post a Comment