‘লেখা’ এবং ‘না-লেখা’, কবিতায় একই সঙ্গে লিখিত হয়। সুতরাং শুধু ‘লেখা’-র প্রকরণ শিখে নিলেই কবিতা লেখা যায় না, যতদিন না সেই রহস্যময় ‘না-লেখা’-র শক্তি কবিতাপ্রয়াসীর আয়ত্তে আসছে। লেখকের মেধা এক্ষেত্রে প্রায়শই তাঁকে কেমন ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে, দেখতে চাইলেই স্পষ্ট দেখা যায়। একেকজন তরুণ কবির লেখা পড়ি ফেসবুকে, কী দারুণ ছন্দের হাত, কী বিচিত্র সব বিষয়ে তাঁদের প্রাজ্ঞ আনাগোনা...! চমকপ্রদ লাইন লিখতে ইতিমধ্যেই বেশ পটু হয়ে উঠেছেন তাঁদের কেউ কেউ! চুপচাপ তাঁদের লেখা লক্ষ করতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই দেখতে পাই— লেখকের আসল অসুখটা বসন্তগুটির মতো ক্রমশ তাঁর কাব্যশরীর ছাপিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে। শুধু তরুণ কবিদের কথাই বা বলি কেন, যে সমস্ত প্রবীণ কবি, প্রাত্যহিক যোগব্যায়াম বা প্রাতঃকৃত্যের মতোই নিয়মিত ‘কবিতা’ প্রসব করে চলেন, তাঁদের লেখাতেও এই একই অসুখ। তরুণ কবিদের নিয়ে তবু আমি অনেকটাই আশাবাদী। আমার বিশ্বাস, আজকের তরুণ কবিরাও কেউ কেউ, একদিন ঠিকই বুঝবেন, কবিতা লেখার জন্য তরোয়ালের মতো কব্জির মোচড় দেখানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। শূন্যে অস্ত্রচালনার মহড়া দিতে দিতে তাঁরা যখন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বেন একদিন, তার অনতি বিলম্বেই হয়তো তাঁদের পরিচয় ঘটবে এক রহস্যময় ‘Nothingness’-এর সঙ্গে। ‘...Till love and fame to nothingness do sink’ । এর থেকেই জন্ম নেয় ‘না-লেখা’-র শক্তি, অনেকটা বাকসংযমের শক্তির মতোই। এই ‘না-লেখা’-র শক্তি লেখককে শুধুই উস্কানি দিয়ে চলে না-লেখার। এমনকী একটা বাক্যের একটিও বাড়তি শব্দকে সে বরদাস্ত করে না। লেখককে সে বাচাল ব’লে, মিথ্যুক ব’লে, কল্পনাবিলাসী ব’লে তিরস্কার করেই চলে অনবরত। এই ‘না-লেখার’ শক্তিই প্রকৃত লেখালেখির প্রেরণা। এই না-লেখার শক্তিই প্রকৃত শক্তিশালী লেখাকে আর পাঁচটা গড়পড়তা লেখা থেকে আলাদা করে দেয়।
সব তরুণ কবিই হয়তো আজ জানেন, রাইনের মারিয়া রিলকে তাঁদেরই মতো এক তরুণ কবিকে উপদেশ দিয়েছিলেন-- মাঝরাতে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করতে, কবিতা কি আমাকে লিখতেই হবে? কবিতা না লিখলে কি আমার মৃত্যু ঘটবে? আমি জানি না, আজকের ‘প্রতিভাবান’ তরুণ কবি, প্রজেক্টের মতো করে আরেকটা নতুন ‘কাজ’ ‘নামিয়ে ফেলার আগে’ ওই কথাগুলো মনে রাখেন কিনা। লাইনের পর লাইন দুর্বোধ্য দিশাহীন লোকঠকানো নিজের লেখাকেই তাঁর নিজস্ব কোনো গোপনে হাস্যকর বলে মনে হয় কিনা।
ফেসবুকে কবিতার নামে যে-নেত্য নিত্যকার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিফলিত হয়, এবং তার পাদদেশে যে পারস্পরিক চুক্তিভিত্তিক, অন্তঃসারশূন্য ‘আহা, উহু, অসাধারণ, অসামান্য, অলোকসামান্য...’ মন্তব্যসমূহ স্বর্ণাক্ষরে খচিত থাকে, তা দেখে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এই মিথ্যে ফেরেব্বাজির পাপ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব প্রত্যাহার করে নেবো। কিছু কিছু তরুণ কবির লেখা ভালো লাগলেও, আজকাল রিঅ্যাক্ট করার বা মন্তব্য করার ঝোঁক থেকে নিজেকে সজ্ঞানে বিরত রেখে বরং অপেক্ষা করি, তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কবে। দেখা হলে, তাঁর প্রাপ্য প্রশংসা, যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পেশ করার সুযোগ যেন আমি পাই। প্রতারক প্রশংসার চেয়ে যা আমার কাছে ঢের পবিত্র বলেই মনে হয়।
নিজের পোস্টে লাইক বাড়াবার কৌশল হিসেবে যাঁরা অপরের লেখায় অভিশম্পাতের মতো ‘অসামান্য-অসাধারণ’ বর্ষণ করে চলেন, আমি তাঁদের মনে মনে ঘৃণা করতে বাধ্য হয়েছি এতদিনে। এমনকী তাঁদের অনাত্মীয় ও শ্রেণিশত্রু বলেও মনে হয় আমার আজকাল। কোনো কোনো কবিতাপ্রয়াসী, আমার অভীষ্ট সহজভাবেই বুঝতে পারবেন বলে আমার ধারণা। সঙ্গে এও আশা করি, মিথ্যে ‘আহা-উহুর’ মোহে অনর্গল, অর্থহীন, নিজের কাছেই দুর্বোধ্য বাক্যরচনা লেখার তাগিদ থেকে তাঁরা নিজের সরল(তরল নয়), পবিত্র ও ব্যাপক সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে চলতে পারবেন।
• ফেসবুকের ‘প্রতিভাবান’ তরুণ কবির প্রতি৷ লিখেছেন: শোভন ভট্টাচার্য
No comments:
Post a Comment