ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী
ভূমিকাকিম কি দুক ১৯৬০ সালের ২০শে ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল ড্রপ আউট কিম কারখানায় শ্রমিক ও সেনাবাহিনীতে নিচু পদে কাজ করে পরবর্তীতে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্যারিসে সড়ক অংকন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর নিজ দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে এসে শুরু করেন চিত্রনাট্য লেখার কাজ এবং ১৯৯৫ সালে কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সামারিটান গার্ল চলচ্চিত্রের জন্য এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে থ্রি আয়রন চলচ্চিত্রের জন্য তিনি সেরা পরিচালকের সম্মানে ভূষিত হন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে পিয়েতা নামক তার চলচ্চিত্রটি ভেনিস, বার্লিন ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের সম্মান লাভ করে এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার লাভ করে। তবে তাঁর সব কীর্তি ছাপিয়ে গেছে যেন বৌদ্ধ দর্শনের বাণী সম্বলিত স্প্রিং, সামার, অটাম, উইন্টার …অ্যান্ড স্প্রিং (২০০৩) সিনেমাটি। মাত্র ৪৪ বছরে এমন গভীর আত্মিক দর্শন সম্বলিত সিনেমা নির্মাণ সত্যিই অভাবিত। পুরো ছবিটির শুটিং তিনি সম্পন্ন করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার একটি মনোমুগ্ধকর নৈসর্গিক এলাকা জুসান হ্রদে। এবং সেখানেই হ্রদের উপর ভাসমান একটি কাঠের প্যাগোডা শুটিংয়ের জন্য তিনি তৈরি করেন। পরিচালক নিজেও হত্যার দায়ে জেল খেটে আসার পর মাঝবয়সী ও অনুশোচনাবিদ্ধ এক সন্ন্যাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই সিনেমায়।এই সিনেমার চিত্রনাট্যটি অনুবাদ করতে গিয়ে স্তম্ভিত হতে হয়েছে। গুনে গুনে মাত্র ৭৪৫ শব্দ। আমাদের দেশে অনেক দর্শকই হয়তো এই ছবিটি দেখেননি ভেবে তাদের জন্য আমিই বরং বন্ধনীতে দৃশ্যগুলো সম্পর্কে সামান্য বাড়তি বিবৃতি যুক্ত করেছি। সিনেমার আসল ভাষা যে সংলাপ মুখরতা নয় বরং ক্যামেরা, আলো, শব্দ, সিনেমাটোগ্রাফি ও চরিত্রদের অভিনয়, সেটাই কিম প্রমাণ করেছেন এই ছবিতে।এই সিনেমার গল্পটি মূলত এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাহিনী যে তাঁর জীবনের শৈশব থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একটি বৌদ্ধ মন্দিরে কাটিয়েছে। পাঁচ পর্বে বিভক্ত এই ছবিতে প্রতিটি পর্ব কিশোর ভিক্ষু ও তাঁর শিক্ষক বা গুরুর জীবনের এক-একটি পর্ব তুলে ধরে। প্রতি দশ বা কুড়ি বছর পর আর একটি পর্ব বা অধ্যায় শুরু হয়।)
…………………
চি ত্র না ট্য
বসন্ত
(একটি হ্রদের ভেতরে ভাসমান এক বৌদ্ধ বিহারে এক প্রৌঢ় ও এক বালক ভিক্ষু)
—ওঠো! জাগো!
—গুরুদেব!
—হ্যাঁ, খোকা? বল?
—আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
—আমাকে ওষুধের জন্য কিছু ভেষজ লতা তুলতে হবে।
—তাহলে আমাকেও সাথে যেতে দিন।
—এসো।
—আমি এখন কিছু লতা-পাতা তুলতে যাচ্ছি, গুরুদেব।
—সাপের ব্যাপারে সাবধান থেক!
—আমার জন্য অপেক্ষা করবেন, গুরুদেব!
—হ্যাঁ।
—আমি আজ অনেক লতা-পাতা তুলেছি, গুরুদেব!
—তাই? তুমি অনেক লতা-পাতা তুলেছ?
—সাবধান! দাঁড়াও! এই লতা-পাতাগুলো ফেলে দাও, খোকা!
—কেন? একই রকম তো দেখতে।
—যদিও একই রকম দেখতে, এটি একটি ভয়ানক লতা যা খেলে মানুষ মরে যায়। অন্য লতাটি জীবন বাঁচায়। তবু দেখতে একই
রকম।
—কী করে বুঝবো কোনটি প্রাণে মারে আর কোনটি জীবন বাঁচায়?
—ভালোভাবে তাকিয়ে দ্যাখো। এই যে এখানে পাতার ডগায় একটি সাদা রেখা দেখতে পাচ্ছ, এই পাতাটি যদি তুমি খেতে তাহলে মারা যেতে। এর পরের বার তুমি এমন পাতা বা লতা আর কখনো তুলবে না, কেমন?
—আর এই পাতাটি কি খেতে কোন দোষ নেই?
—হ্যাঁ, এটা ঠিক আছে।
—গুরুদেব! আমার পিঠে একটি পাথর রয়েছে। এটি সরিয়ে ফেলুন না দয়া করে!
—এটা কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে?
—হ্যাঁ, গুরুদেব।
—তুমি কি এই একই কাজ ঝর্ণার মাছটির সাথে করোনি?
—হ্যাঁ, গুরুদেব।
—তুমি কি এই একই কাজ ব্যাঙটির সাথে করনি?
—হ্যাঁ, গুরুদেব।
—এই একই কাজ কি তুমি সাপটির সাথে করোনি?
—হ্যাঁ, গুরুদেব।
—দাঁড়াও! হাঁটো!
—আমি হাঁটতে পারছি না! পিঠের পাথরটা এত ভারি!
—তাহলে ভাবো তো কীভাবে ঐ মাছ, ব্যঙ আর সাপটি তাদের পিঠে তোমার বেঁধে দেওয়া পাথরের ভার সহ্য করছে?
—আমার অন্যায় হয়েছে, গুরুদেব!
Spring, Summer, Fall, Winter… and Spring
—যাও এবং সবগুলো প্রাণীকে খুঁজে বের করে ওদের পিঠ থেকে তোমার বেঁধে দেয়া পাথরগুলো খুলে দাও। তখন আমিও তোমাকে মুক্ত করব।
—কিন্তু যদি এই প্রাণীগুলোর কোনটা—মাছ, ব্যঙ অথবা সাপ মরে যায়?
—তাহলে বাকি জীবনটা তুমি তোমার হৃদয়ে এই পাথর বহন করে চলবে।
গ্রীষ্ম
(এক মা ও তার অসুস্থ তরুণী মেয়ে বিহারের পথে চলেছেন। যুবক ভিক্ষু পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার সময় অসুস্থ মেয়েটিকে বলছে)
—তোমাকে এত ভাল দেখাচ্ছে! এই গাছটা বহু বছরের পুরনো। তুমি এই গাছটির মত সুস্বাস্থ্য পাবে।
— (মা ও মেয়ে প্রবীণ ভিক্ষুকে সম্ভাষণ জানায়)
—নমস্কার!
—ভেতরে আসুন!
—হে ভিক্ষু মহোদয়! আমার মেয়ে কি সুস্থ হবে?
—আমার মনে হচ্ছে যে কোনো কারণে ওর আত্মা পীড়িত হয়ে আছে। যেদিন ওর চিত্তে শান্তি ফিরে আসবে, সেদিন ও আবার সুস্থ হয়ে যাবে।
—দয়া করে ওকে একটু দেখবেন।
(তরুণ ভিক্ষু মঠে আশ্রয় নেয়া অসুস্থ মেয়েটিকে)
—শুনুন? এখানে আপনার বসার কোন অনুমতি নেই! গুরুদেব দেখলে আপনার উপর রাগ করবেন।
(রাতের বেলা। যুবক ভিক্ষু সুস্থতার প্রত্যাশায় আশা নিদ্রিত তরুণীর গায়ে চাদর দিতে গিয়ে তার স্তন স্পর্শ করে, মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে তাকে চড় মারে এবং অনুশোচনায় যুবক ভিক্ষু প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করে। সহসা প্রার্থনা শুনে প্রবীণ ভিক্ষুর ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং তিনি শিষ্যকে বলেন)
—তুমি বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে প্রার্থনা করা শুরু করলে কেন?
(যুবক ভিক্ষু তরুণী মেয়েটিকে বলছে)
—তুমি কি আমার সাথে আসবে?
(নরমভাবে হাতে ভেষজ ওষুধের নির্যাসের পাত্র হাতে যুবক ভিক্ষু মেয়েটিকে বলছে)
—এটা অবশ্যই সত্যিকারের শুদ্ধ অন্তঃকরণে ভালো বানাতে হবে। এই পাতার রসটুকু খেয়ে নাও। এটা তোমার মাথা পরিষ্কার করে দেবে।
(রাতের বেলা যুবক ভিক্ষু এবং তরুণী অভিসারের লক্ষ্যে নৌকায় চড়েছে)
—নৌকাটি ভেসে যাচ্ছে!
—থামান! থামান!
—তুমি কি এখন সুস্থ?
—হ্যাঁ, আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ।
—কি যে আশ্চর্য! তোমাকে দেখতে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাই। আমার কি হয়েছে?
(কিছুক্ষণ পরে ওরা দুজন নৌকায় ঘুমিয়ে পড়লে এবং বৃদ্ধ ভিক্ষু ঘুম ভেঙ্গে ওদের না পেয়ে বাইরে এসে নৌকায় দু’জনকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখে নৌকার গলুই ফুটো করে দিলে জলের স্পর্শে মেয়েটি জেগে ওঠে)
—শীত! কি ঠান্ডা!
—আমি এখন কি করব?
—আমি অন্যায় করেছি, গুরুদেব! আমাকে ক্ষমা করুন।
—এমনটা নিজে থেকেই হয়ে থাকে। এটাই প্রকৃতির স্বভাব।
(প্রবীণ ভিক্ষু তরুণীর দিকে ফিরে)
—তুমি কি এখনো অসুস্থ?
—না।
—তাহলে এই ওষুধ ঠিকই ছিল। এখন তুমি যখন সুস্থ হয়েছ, তুমি এই জায়গা ছেড়ে যেতে পার।
—না, গুরুদেব! ও যেতে পারে না!
—কামনা-বাসনা অধিকারবোধের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। এবং সেই অধিকারবোধের বাসনা খুন বা হত্যার অভিপ্রায় জাগিয়ে তোলে।
শরৎকাল
(বৃদ্ধ ভিক্ষু নৌকা চালিয়ে পাশের গ্রামের হাট থেকে ফিরে, স্বগত কণ্ঠে)
—আজ বেশ ধকল গেল, না?
(সংবাদপত্র খুলে)
—এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে হত্যা করে পলাতক।
(শিষ্য তথা হত্যাকারী এসেছে)
—ভেতরে এসো! তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ! ভেতরে এসো! তা এতদিন কি খুব সুখী জীবন কাটালে? তোমার জীবনের মজার কিছু আমাকে বলো। এই নশ্বর পৃথিবী কি তোমার জন্য পরিতাপময় হয়ে উঠেছে?
—বাদ দিন, গুরুদেব! আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে আমি কেমন কষ্ট সইছি?
—তোমার যন্ত্রণার কারণ কি জানতে পারি?
—আমার একমাত্র পাপ ছিল ভালবাসা। আমি তো ওকে ছাড়া আর কিছু চাইনি!
—তো?
—সে কিনা আরেক জন পুরুষের সাথে চলে গেল!
—হ্যাঁ, তেমনটাই হয়েছে।
—এটা কিভাবে হতে পারে? সে কিভাবে এমনটা করল? সে বলেছিল যে, সে শুধুমাত্র আমাকেই ভালবাসবে।
—আর তারপর?
—আমি এটা আর সহ্য করতে পারিনি।
—তুমি কি আগে জানতে না যে পুরুষের পৃথিবী কেমন? মাঝে মাঝে আমরা যা সবকিছু ভালবাসি, সেসবকে ছেড়ে দিতে হয়। তোমার যাকে ভালো লাগছে, তাকে অন্যদেরও ভালো লাগতে পারে।
—কিন্তু তারপরও…ও কিভাবে এটা করতে পারলো? কুত্তী কোথাকার!
—এটা কি তোমার জন্য এতটা দূর্বহ?
—হ্যাঁ।
—গুরুদেব! গুরুদেব!
—বলো, মূর্খ জোয়ান কোথাকার! যদিও তুমি নিজে এত সহজে এক জনকে খুন করতে পার, তুমি নিজে তো আর এত সহজে খুন হতে পার না । এই কাঠের পাটাতনে ছুরি দিয়ে সব অক্ষরগুলো খচিত করো। আর প্রতিটা অক্ষর যখন কাঠের উপর খোদাই করবে, তখন নিজের মনের রাগকেও একে একে বিসর্জন দেবে।
(দুই ম্যাজিস্ট্রেট নদীর ওপার থেকে)
—হে পরম ভিক্ষু! আমরা একটি তদন্তের কাজে এসেছি।
পরম ভিক্ষু!
(ম্যাজিস্ট্রেটদ্বয় যুবক হত্যাকারীকে উদ্দেশ্য করে)
—হাতের ছুরি ফেলে দাও! নয়তো তোমাকে আমরা গুলি করব।
—তুমি কি করছ এটা?
—খোদাই কাজ! প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র। এটা মনকে শান্ত করে।
(ভিক্ষু, দুই ম্যাজিস্ট্রেটকে)
—দয়া করে ওকে কাজটি শেষ করতে দিন।
—কতক্ষণ লাগবে এটা শেষ হতে?
—কাল সকাল পর্যন্ত।
(সকালবেলা। এক ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল হাতে নিয়ে অন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে বলছে)
—উঁহু, কোনো সংযোগ নেই।
—সংযোগ নেই?
—এটা এক দুর্গম উপত্যকার ভেতরে আমরা আছি, তাই না?
—কী?
—এরা সাদা ঝিনুক দিয়ে এই রঙগুলো বানায়, তাই না?
—দাঁড়াও!
—এখন যাবার সময় হয়েছে।
—গোয়েন্দা চই, চলুন আমরা যাই এখন!
—গোয়েন্দা চি, নৌকা আর সামনে এগোবে না।
—আহ্, এখন আস্তে আস্তে নড়ছে।
শীত
(কোনো সংলাপ নেই)
এবং বসন্ত
(কোনো সংলাপ নেই)
সমাপ্ত
সৌজন্য: ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটি।
No comments:
Post a Comment