ভাস্কর চক্রবর্তী: এক অপার বিস্ময়


দেবলীনা রায় চৌধুরী::

ভাস্করের চলে যাবার দিন। এই ভীষন স্বকীয় কোলাহল, প্রতি পদে উচ্চকিত ঘোষণা দিয়ে জানানো আমি আছির যুগে আমি একজন ভাস্করকে দেখি। ঘটে চলা রোজকার বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থান করা একজন তিনি। চুপ থাকতে পারা যে যুগের ধর্ম নয়।

বিখ্যাত, বিখ্যাত আর বিখ্যাত হতে চাওয়ায় মধ্যে একধরণের অশ্লীলতা আছে

এখন তারই প্রকাশে চোখ অভ্যস্ত, বিরক্তও বটে। এই ভীষন সহজ ভাবে বলে দেওয়া সত্যিটুকুর প্ৰকাশ তো এভাবে করতে আমি আর কাউকেই দেখিনি এযাবৎ। দেখবোনা খুব সম্ভবত।

চুপ করে থাকা এই যুগের লজ্জাজনক অপারগতা। আর বিখ্যাত হতে চাওয়ার দায় তো কোন আদিমযুগ থেকেই আমরা সসম্মানে স্বীকার করেই নিয়েছি। তবু অল্প কিছু মানুষ জন্মান। তারা দায়মুক্ত, ভারহীন। একা নিরালা, নির্জনে তাদেরই কেউ হয়ে ওঠেন একজন সত্যিকারের কবি। কল্লোলিনী কলকাতা তাঁকে কতটুকু নির্জনতা দিতে পেরেছে, কতটুকু আড়াল আমার জানা নেই। তবু যেটুকু তিনি ধরে রেখেছেন নিজের কাছে,তার অনেকটা ফেরত দিয়েছেন পাঠকদেরও। আর যেটুকু ফেরত দিয়েছেন সেইটুকুর মধ্যে কোথাও একবিন্দু খাদ নেই বলেই আমার বারবার মনে হয়েছে। কতটুকু সত্যি আর কতটুকু কবিতা এই প্রশ্ন উঠবেই না সেখানে। কারণটা যারা ভাস্কর পড়েন তারা জানেন অবশ্যই।

হয়তো অনেকে বলবেন পুরস্কারের কথা, সম্মানের কথা, প্রাপ্তির কথা। হ্যাঁ, সত্যি হয়তো প্রাপ্যটুকু থেকে ভাস্কর বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাঁকে যতজনের চেনার কথা ছিল চিনেছে তার থেকে কমই। তবু যেন তাঁর এই আড়ালই বারবার তাকে আলাদা করেছে সকলের থেকে, আর আমায় করেছে মুগ্ধ। তিনি আড়ম্বর থেকে দূরে, বহু দূরে বরং এই বিষয়টাই বরাবর তাঁর পাঠকদের অদ্ভুত শান্তি দিয়েছে। সেটাই তাঁর ক্রাফটের বৈশিষ্ট্য।

তাঁর কবিতা প্রচুর মানুষ পড়ুক এটি যেমন আমি চাই, আবার এই একান্ত আবিষ্কারের বিস্ময় সরে গিয়ে সেটি হবে সার্বজনীন এই ভাবনা আমায় বড় অভিমানীও করে তোলে। প্রিয় যা কিছু নিয়ে অভিমান করার সেই অধিকার। এই সবটুকু নিয়েই ভাস্কর আমার কাছে এক অপার বিস্ময়। তাঁকে চেনা এখনো অনেক বাকি। কি এক অভিমান নিয়ে তিনি আজীবন রইলেন অন্তরালে মুচকি হেসে। তারপর এক জীবন থেকে অন্য ভুবনেও দিব্যি চলে গেলেন। দিয়ে গেলেন জীবনের প্রতি আশ্চর্য এক কাব্যময় উদাসীনতা:
রক্তে বিষ মিশে আছে প্রিয়তমা, এখন জীবন যায়,
আস্তে চলে যায়...

No comments:

Post a Comment