এক
হাংরি আন্দোলনকারীদের অবনিবনা নিয়ে যতো খিল্লি হয় তা কিন্তু পরাবাস্তববাদীদের মাঝে অবনিবনা নিয়ে হয় না, কোনও ভাষাতেই হয় না, দুই বাংলাতেও নয় । অথচ পরাবাস্তববাদীদের পরস্পরের ঝগড়া এমনকী হাতাহাতি অনবরত কতোজনের সঙ্গে যে প্রত্যেকের হয়েছিল তার কোনও হিসেব নেই । অথচ হাংরি আন্দোলনের আলোচনা শুরু করলেই সবাই তাঁদের পারস্পরিক অবনিবনা নিয়ে খিল্লি করেন ; লেখালিখি বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করেন না বা করতে চান না, বাঙালি আলোচকরা । হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রায় সকলের অন্তত পাঁচটি থেকে দুশোটি বই প্রকাশিত হয়েছে ।
‘আয়নানগর’ পত্রিকার অক্টোবর ২০১৬ সংখ্যায় নন্দিনী ধর হাংরি আন্দোলন আলোচনা করতে বসে দুম করে লিখে দিলেন যে আমার সংকলিত বই থেকে শৈলেশ্বর ঘোষকে বাদ দিয়েছি ; অথচ আমি হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার কোনো সংকলন প্রকাশ করিনি । নন্দিনী ধর লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা নিজেদের ‘ছোটোলোক’ ঘোষণা করে বিবিক্ততাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন ; উনি জানতেন না যে আমি পাটনায় ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত বস্তি-এলাকায় থাকতুম, অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি আর পরে ক্রেন-ড্রেজার-ডাম্পার অপারেটার, লরি-ট্যাকসি-প্রায়ভেট মোটরগাড়ি চালক, রেলওয়ে ক্যাটারিঙের বেয়ারা, কোককয়লা ফেরি, ঠোঙা ও প্যাকেট তৈরি, পোস্টার-ফেস্টুন লেখা ইত্যাদি, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য যে-ধরণের কাজ পাওয়া যায় সবই করেছিলেন । সমীরণ ঘোষ ছিলেন ডাকপিওন, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিবার থেকে, দেবী রায় চায়ের ঠেকে চা বিলি করতেন, শম্ভু রক্ষিত নিজের গ্রামে চাষবাস করতেন, নিজেই প্রেসে গিয়ে কমপোজ করতেন, সুবিমল বসাকের শৈশবে পরিবারকে পথে বসিয়ে তাঁর বাবা দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় হিন্দি পত্রিকার মলাট এঁকে রোজগার করতেন, ফালগুনী রায় কিছুই করতেন না । এ-থেকে টের পাওয়া যায় যে আলোচকরা কোনও বই পড়ার আগেই ভেবে নেন যে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনার সময়ে কী লিখবেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের সমাজচিন্তা ও বিশ্ববীক্ষার তর্ক-বিতর্ক ও লেখালিখি বাদ দিয়ে আলোচকরা তাঁদের অবনিবনাকে গুরুত্ব দেন ।
অন্য বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা এমন অডিটরসূলভ বিশ্লেষণ করতে বসেন না । বিদেশি সাহিত্যিকদের মাঝে নিজেদের বিশ্ববীক্ষার সমর্থনে পারস্পরিক বিবাদ-বিতর্কের কথা যেমন শোনা যায় তেমনটা বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে বড়ো একটা লেখালিখি হয় না । আমরা পড়েছি টলস্টয় – ডস্টয়েভস্কি বিবাদ, গোর ভিডাল আর নরম্যান মেইলারের বিবাদ এমনকি হাতাহাতি, ভারগাস য়োসা ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের, ভ্লাদিমির নবোকভ – এডমাণ্ড উইলসন বিবাদ, মার্ক টোয়েন – ব্রেট হার্ট বিবাদ, আলেকজাণ্ডার পোপ – জন হার্ভে বিবাদ, সিংকলেয়ার লিউইস – থিয়োডোর ড্রেজার বিবাদ, সালমান রুশডি – জন আপডাইক বিবাদ, হেনরি জেমস – এইচ জি ওয়েল্স বিবাদ, জোসেফ কনরাড – ডি এইচ লরেন্স বিবাদ, ভার্জিনিয়া উলফ – অ্যারনল্ড বেনেট বিবাদ, সি. পি. স্নো – এফ. আর. লিভিস বিবাদ, জন কিটস – লর্ড বায়রন বিবাদ, চার্লস ডিকেন্স – হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসন বিবাদ, পিকাসো-দালি বিবাদ, আলবেয়ার কামু – জাঁ পল সার্ত্রে বিবাদ, মার্সেল প্রুস্ত – জাঁ লরেনস বিবাদ, রিচার্ড ফোর্ড – অ্যালিস হফম্যান বিবাদ, ডেরেক ওয়ালকট – ভি এস নাইপল বিবাদ, হেমিংওয়ের সঙ্গে ওয়ালেস স্টিভেন্স, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, ও উইলিয়াম ফকনারের বিবাদ, ইত্যাদি । আলোচকরা কিন্তু তাঁদের রচনাবলী বিশ্লেষণের সময়ে সৃজনশীল কাজকেই গুরুত্ব দেন, বিবাদ নিয়ে খিল্লি করেন না ।
বাঙালি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মনে করেন মানুষ ও প্রাণীরা এসেছে অন্য গ্রহ থেকে, তিনি অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য । ওই একই দপতরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পাশের কেবিনেই বসতেন ,যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, ডারউইনের তত্বে বিশ্বাস করতেন, বামপন্হী ছিলেন । অথচ পরপস্পরের লেখা আলোচনার সময়ে এই বিষয়গুলো ওনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত, যেন সাহিত্য আলোচনায় লেখকের বিশ্ববীক্ষার ও কৌমচিন্তার কোনো প্রভাব থাকে না । অধিকাংশ বাঙালি সাহিত্যিক এই ধরণের ভাই-ভাই ক্লাবের সদস্য । এদিকে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনা করতে বসে তাঁদের ব্যক্তিগত অবনিবনাকে তুলে ধরতে আগ্রহী, আর লেখালিখি না পড়েই খিল্লি করেন।
এই তো সেদিন ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্হ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, পড়ার সময়ে হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা পড়ছিলুম । উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন । একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় । সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য টেবিলে উঠে পড়লেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সাংবাদিকরা, ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না । তাঁরা গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা । ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে । ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম ছোটো গল্পকার ।
গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:
জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,
হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ
শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।
উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ ।
১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন এবং তাঁরও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । শতভিষা, কৃত্তিবাস, কবিতা, ধ্রুপদি পত্রিকার কর্নধারদের প্রিয় সঙ্গীত-জগত থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া এই গান সেসময়ে নিতে পারেননি সাংবাদিক আর বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, তার ওপর যেহেতু হাংরি আন্দোলনের ব্যাপার, তাই তাঁরা এটাকে অশিক্ষিত নেশাখোর-মাতালদের কারবার ভেবে হেঁ-হেঁ করে হেসে খিল্লি উড়িয়ে ছিলেন ।
দুই
উত্তরবঙ্গে হাংরি জেনারেশনের প্রসার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, হাংরি পত্রিকা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর সম্পাদক অলোক গোস্বামী তাঁর রচনা ‘মেমরি লোকাল’-এ এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তা থেকে অবনিবনার যৎসামান্য আইডিয়া হবে, আর এই অবনিবনার সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের অবনিবনার যথেষ্ট মিল আছে :-
“নব্বুই দশকে সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্যবশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
–কী চাই!
মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
–কে আপনি?
এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
–কি কথা?
–গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
–কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
–এভাবে কথা বলছেন কেন?
–যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে ‘ছেলেধরা’ বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
–ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
–কোন পত্রিকা?
–কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
–নেব না। যান।
এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি।
শৈলেশ্বরের হাত ঝাপটানিতে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ থেকে সরে গেলেন অনেকে। অরুণেশ ঘোষ তো সরে গিয়েছিলেনই, সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর কিছু কাছের মানুষজনকেও, যাদের কাউকে কাউকে আমরাও কাছের মানুষ ভাবতাম। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে গেল না। বরং ‘কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প’-এর কভারে লিখে দিলাম, “সত্যের ঘাত অসহ্য হলে বুর্জোয়া ভাইরাসেরা গড়িয়ে যায় নিজস্ব ভাগাড়ের দিকে।” লিখে দিলাম, “ জানি পাঠক, তুমি পাজামা কিংবা পেন্ডুলাম নও।”
কিন্তু আমাদের কিছু না এসে গেলেও একজনের গিয়েছিল, সুভাষ ঘোষের। চটে গিয়েছিল সুভাষ-শৈলেশ্বর রসায়ন। যদিও নিজস্ব অবস্থান এবং অসহায়তার কথা বন্ধু ‘শৈলেশ’কে আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলেন সুভাষ, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা এতটাই চরমে উঠেছিল যে খোদ কোলকাতাতেই শৈলেশ্বরের ইশারায় সুভাষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিতও হোতে হয়েছিল। বাল্যবন্ধুর সেই লাঞ্ছনা সংবাদ উত্তরবঙ্গের অনুচরদের কাছে পৌঁছে দিতে দ্বিধা দেখাননি শৈলেশ্বর ঘোষ।
হ্যাঁ, ততদিনে এক অলিখিত নিয়মে ক্ষুধার্ত শিবির ত্রিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে যেটা আমাদের আদৌ অভিপ্রেত ছিল না। এক শিবিরের অধিনায়ক শৈলেশ্বর ঘোষ। অন্য শিবিরের অধিনায়ক মলয় রায়চৌধুরী এবং তৃতীয় শিবির ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’, যার নেতৃত্বের দায় জোর-জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হলো সুভাষের কাঁধে। অথচ আমরা কোনদিনই কারো নেতৃত্বকে স্বীকার করার মতো অবস্থানে ছিলাম না। সুভাষও অপচেষ্টা করেননি চেপে বসার, তবু ইতিহাসের রসিকতা বোধের ফের একবার প্রমাণ পাওয়া গেল। ইতিহাসের রসিকতা বলার কারণ সেই ষাটের দশকে প্রকাশিত সুভাষের একটি গদ্যগ্রন্থের নাম ছিল,‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট।’ নামকরণের সেই ক্ষণে সুভাষ কি আদৌ ধারণা করতে পেরেছিলেন ভাবী সময় কোনওদিন তাঁকে সত্যি সত্যি এমন জায়গাতেই এনে দাঁড় করাবে?
রসিকতা দূরে থাক, মূল সত্য এটাই যে, এরপরও সুভাষ ঘোষের কোনো নিজস্ব শিবির ছিল না। ছিল না নিজস্ব অনুচর বাহিনী। ছিল না সঙ্গী নির্বাচনের উপযুক্ত কোনো মেটাল ডিটেক্টর। এমন কী মনমতো হাংরি ইতিহাস লেখারও কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না। যা ছিল তা শুধু ঘাড় নীচু করে লিখে যাওয়া, নিজের লেখা পাঠ করে শোনানোর পাশাপাশি তরুণ লেখকদের লেখা শোনা এবং মতামত দেয়া। এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও ছিল না সুভাষের। যে কোনো যৌথতায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির হতে আপত্তি ছিল না কোনো।
আমাদের অবাধ্য হওয়ার নমুনা পাওয়া মাত্র শৈলেশ্বর ঘোষ ভিন্ন শিবিরের খোঁজার পালা শুরু করে দিয়েছিলেন। সৃষ্টিশীলতা, ইতিহাস প্রসিদ্ধি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির ত্র্যহস্পর্শে পেয়েওছিলেন তৃতীয় প্রবাহের সন্ধান। তবে এক্ষেত্রে খানিকটা সমঝোতা করতে উনি রাজী হয়েছিলেন। যেমন ওই শিবির কবি শৈলেশ্বরকে স্বীকৃতি দিলেও ক্ষুধার্ত আন্দোলনের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না। অবশ্য তখন শৈলেশ্বরের তাতে আর কিছু এসে যায় না। যথারীতি সে পর্বও দীর্ঘদিন লাস্টিং করলো না। করার কথাও নয়, জানতাম আমরা। কিভাবে জানতাম বলতে চাইছি না। অহেতুক তৃতীয়পক্ষকে টেনে কী লাভ ! বরং সেসময়ের একটা শ্লোগানের কথা বলি– “অস্তিত্ব পুড়ছে, আসুন সেই আলোয় আমরা পরস্পকে শনাক্ত করি।”
উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রসার সম্পর্কে রাজা সরকার লিখেছেন,”প্রসঙ্গত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’এ সুভাষ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর আমরা নানা ভাবে আক্রান্ত বোধ করতে থাকি। সেই সাক্ষাৎকারে হাংরি কনসেপ্ট নিয়ে সুভাষের কথায় অনেকে অস্বস্তি বোধ করেন। অনেকেই আন্দোলন নিয়ে সুভাষের কথার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদেরও তার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। সঙ্ঘ ভাঙা মানুষেরা বোধ করি কোনও সঙ্ঘ আর পছন্দ করেন না। কিন্তু ততদিনে পাশাপাশি আমরা জেনে যাচ্ছি যে হাংরিদের অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য, মামলা কেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তিগত বিভেদের সালতামামি। এসব অগ্রাহ্য না করতে পারলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। ততদিনে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ফালগুনী রায় ও অবনী ধর এর লেখা আমরা আমাদের কাগজে পুনঃ প্রকাশ করতে শুরু করি। হাংরি লেখকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইও ঐসময় ‘কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পের’ লেখকদের নিজ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ।”
তিন
অলোক গোস্বামী আর রাজা সরকারের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, পরাবাস্তববাদীদের মতনই, শৈলেশ্বর ঘোষের হয়তো মনে হয়েছিল যে কলকাতায় তিনি হাংরি আন্দোলনের যে কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছেন তাতে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করছেন সুভাষ ঘোষ । তাঁর আচরণ ছিল হুবহু আঁদ্রে ব্রেতঁর মতন । সুভাষ ঘোষের আচরণ ছিল লুই আরাগঁর মতন ; লুই আরাগঁ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু আঁদ্রে ব্রেতঁ থেকে, মতান্তরের কারণে ।পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক ভালো ছিল না, দল অজস্রবার ভাগাভাগি হয়েছিল, অথচ সেসব নিয়ে বাঙালি আলোচকরা খিল্লি করেন না, যতোটা হাংরি আন্দোলনের দল-ভাগাভাগি ও বিবাদ নিয়ে করেন। ইংরেজিতে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন, পেঙ্গুইন র্যাণ্ডাম হাউস থেকে প্রকাশিত । সেই বইটি বাংলা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হল না । ইংরেজিতে হাংরিদের সম্পর্কে সংকলিত “লিটারেচার অফ দি হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট : আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট” বইটিও আলোচিত হল না ; হাংরি আন্দোলনের চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই সম্পর্কে জুলিয়েট রেনল্ডসের লেখা ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ : অন দি লাইফ, টাইমস অ্যাণ্ড আর্ট অফ অনিল করঞ্জাই’ বইটির আলোচনা হল না । অথচ বিট ও পরাবাস্তব আন্দোলন সম্পর্কে লেখা প্রায় সব বইই আমেরিকান ও ইউরোপীয় পত্রিকায় আলোচনা হয় । মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী তাঁর বইতে লিখেছেন যে, “আন্দোলনটি সম্পন্ন হওয়ার পরে, বিশ্ব তাদের ভারতবর্ষের সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে মর্মভেদী, সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবশালী এবং উদ্ভাবনী শিল্পীর দল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যাদের জীবন একটি অসাধারণ ফ্রেমে বিস্তৃত হয়েছিল, ফলে অনেকের কাছে বৃহত্তর চিত্রটি ছিল পরিবর্তিত । এই লেখক-কবিরা ছিলেন গোষ্ঠীভূত, আকস্মিক বিদ্রোহী এবং এই আন্দোলনটি নেহাত বিকল্প জীবনধারা ছিল না, বরং ছিল জীবন ।”
অবনিবনা প্রসঙ্গে সালভাদর দালি ও পিকাসোর বিবাদ নিয়ে, তাঁদের ছবিগুলো আলোচনায় খিল্লি করেন না আলোচকরা । আলোচিত হয় তাঁদের অবদান । ১৯৩০ সালে পরাবাস্তব আন্দোলনে দালি ছিলেন একজন বিতর্কিত সদস্য এবং অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে, তাঁর সংঘাত ঘটত প্রায়ই । এমনকী, ১৯৩৪ সালে পরাবাস্তববাদীরা একটি ‘বিচারসভা’ বসিয়ে’ দালিকে আন্দোলন থেকে বের করে দেন । দালিকে তাঁরা মনে করতেন প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্যবাদ-বিরোধী, এবং ফ্রাংকোর চাটুকার চিত্রশিল্পী । বের করে দেবার পরও বহুকাল পর্যন্ত দালি পরাবাস্তববাদী চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশ নিতেন । দালি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায় । পিকাসো ছিলেন জেনেরাল ফ্রাংকোর শাসনের বিরোধী এবং বলেছিলেন যে যতোদিন ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী শাসন থাকবে ততোদিন তাঁর আঁকা ‘গুয়ের্নিকা’ স্পেনে ঢুকবে না । পিকাসো সারাজীবন সাম্যবাদী ছিলেন । এই পরস্পরবিরোধীতা নিয়ে, তাঁদের পেইনটিঙ আলোচনার সময়ে কিন্তু খিল্লি করা হয় না । দালি বলেছেন যে যখন তিনি আঁকেন তখন কী আঁকছেন তা নিজেই বুঝতে পারেন না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ছবিগুলোর কোনও মর্মার্থ নেই ; বরং বিপরীত, তাদের মর্মার্থ এতো জটিল, অনৈচ্ছিক, সুসংহত ও গভীর যে সেগুলো যৌক্তিক স্বজ্ঞাততার সবচেয়ে সাধারণ বিশ্লেষণ থেকে মুক্ত । দালি বলতেন যে তিনি তাঁর মৃত ভাই হিসেবে পুনর্জন্ম নিয়েছেন আর তাই তিনি দ্বৈত চরিত্রের মানুষ । এই ধরণের কথাবার্তা যদি ছবি-আঁকিয়ে সুবিমল বসাক, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় বা অনিল করঞ্জাই বলতেন, তাহলে বাঙালি আলোচকরা তার খিল্লি করবেন ।
আলোচকরা মনে হয় জানেন না যে সুভাষ ঘোষ ছিলেন সিপিএমের কার্ড হোলডার, তাঁর বাড়ি থেকে গণশক্তি পত্রিকা বিতরণ হতো এবং লাঠিতে পরানো সিপিএমের ঝাণ্ডা তাঁর বাড়িতে ডাঁই করে রাখা থাকতো ; কমিউনিজম নিয়ে মাওবাদে বিশ্বাসী বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মার্কসবাদী সুভাষ ঘোষের সিরিয়াস তর্ক-বিতর্ক ঘটেছিল, অথচ তা বিশ্লেষিত হয় না । কেবল তাঁদের অবনিবনা নিয়ে খিল্লি হয় ।
চার
আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে গৌতম চক্রবর্তী হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন ; তাতেও রয়েছে খিল্লি, যা তিনি পরাবাস্তববাদীদের সম্পর্কে কখনও করেছেন কিনা জানি না । উনি লিখেছিলেন :
“মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।… এখন কবিতা রচিত হয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।
১৯৬২ সালে এই ভাষাতেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো। ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা ‘হাংরি জেনারেশন’। নীচের লাইনে তিনটি নাম। ‘স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা: দেবী রায়।’
তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেওয়ালে লেখা হয়নি ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে-যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে ‘ভারতী’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন। কিন্তু এই ভাবে সাইক্লোস্টাইল-করা ম্যানিফেস্টোয় আগে কখনও ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।
ওটি হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানায়, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না। ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.’ বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ, পটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পটনায় বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।
দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। হাংরি আসলে সেই আন্দোলন, যার কোনও কেন্দ্র নেই। ফলে শহরে, মফস্সলে যে কোনও কবিই বের করতে পারেন তাঁর বুলেটিন। ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘মুক্ত কবিতার ইসতাহার’-এ ছাপিয়ে দিলেন ‘সমস্ত ভন্ডামির চেহারা মেলে ধরা’, ‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা’, ‘প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করা’, ‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’ ইত্যাদি ২৮টি প্রতিজ্ঞা। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধবে। মলয় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবেন। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরীরা বলবেন, ‘মলয় বুর্জোয়া সুখ ও সিকিয়োরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।’কী রকম লিখতেন হাংরিরা? বছর দুয়েক আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে গৌতম ঘোষের চরিত্রটি লেখা হয়েছিল হাংরি কবিদের আদলে।
‘জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি
মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বউদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম’,
লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফালগুনী রায়। র্যাঁবো, উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। ঘটনা, এঁরা যত না ভাল কবিতা লিখেছেন, তার চেয়েও বেশি ঝগড়া করেছেন। এবং তার চেয়েও বেশি বার গাঁজা, এলএসডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফিটোমাইন ট্রিপে গিয়েছেন।
অতএব, সাররিয়ালিজ্ম বা অন্য শিল্প আন্দোলনের মতো বাঙালি কবিদের ম্যানিফেস্টোটি কোনও দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ‘হাংরি’রা আজও মিথ। এক সময় ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ বলে তৎকালীন মন্ত্রী, আমলা, সম্পাদকদের বাড়িতে ডাকযোগে তাঁরা মুখোশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার এক সময় ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার মামলা হল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাকের বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেফতারি পরোয়ানা।
রাষ্ট্র ও আদালত কী ভাবে কবিতাকে দেখে, সেই প্রতর্কে ঢুকতে হলে ১৯৬৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্পর্কে জানা জরুরি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসিকিউটরের জিজ্ঞাসা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?
শক্তি: ভাল লাগেনি।
প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভাল লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
শক্তি: ভাল লাগেনি মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। কোনও কবিতা পড়তে ভাল লাগে, আবার কোনওটা ভাল লাগে না।
শক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন মলয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়ের সমর্থনে…
প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
সুনীল: কই, না তো। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল লিখেছে।
প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?
সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে সব কিছু হয় না।
একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, ’৬৫ সালে এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগের বছরই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একটি চিঠি দিয়েছিলেন, ‘লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো? মনে হয়, খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।’ ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তাঁর পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের ‘সুনীলদা’ হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই। প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে, ‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।…আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’
তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা। হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিটল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়। আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ। সেখানে কবিতায় বাঁকাচোরা ইটালিক্স, মোটাদাগের বোল্ড ইত্যাদি হরেক রকমের টাইপোগ্রাফি ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?
আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। ’৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইন, ‘কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।’ হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী।”
গৌতম চক্রবর্তী লেখেননি যে ম্যানিফেস্টো আর বুলেটিনগুলো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ কফি হাউস, আনন্দবাজার, যুগান্তর, কবিতা ভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি, স্কটিশ, আশুতোষ, সিটি কলেজ ইত্যাদিতেও বিলি করা হয়েছিল এবং পাঠানো হয়েছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হাংরি আন্দোলনকে ফিল্মে খিল্লি করেছিলেন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাইশে শ্রাবণ-এ । কোনও প্রয়োজন ছিল না অথচ তিনি গৌতম ঘোষকে একজন হাংরি কবি হিসেবে তুলে ধরলেন যার লেখা নাকি কোথাও ছাপা হয় না আর যার বুদ্ধিবিভ্রম ঘটে গেছে । হাংরি আন্দোলন এই সিনেমায় এসেছে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী’র হাত ধরে। মানসিক বিকারগ্রস্থ এই কবি হাংরি আন্দোলনকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন এবং কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গভীর রাতে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ান, সেলফোনে তাঁর কবিতার বইয়ের প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনান রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত, কলকাতা বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে। এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কোলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিঙ একসময় এই কবির দিকেই আঙ্গুল তুলে ধরে।
লোকটা কেমন হাংরি, যার বন্ধুবান্ধব নেই, দল নেই, কফি হাউসে যায় না, খালাসিটোলায় যায় না, বন্ধুদের নিয়ে হ্ইচই করে না, মধুসূদনের সমাধিতে খালাসিটোলায় বারদুয়ারিতে হাওড়া স্টেশনে নিমতলা শ্মশানে কফি হাউসে দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে কবিতা পড়ে বন্ধুদের শোনায় না, মাদক নেয় না, নিজেদের দলের পত্রিকা নেই, নিজেই লিফলেটে ছাপাবার বদলে একজন খোচরের ওপর নির্ভর করে কবিতা প্রকাশের জন্য ! প্রসঙ্গত আমি প্রকাশ করতুম ‘জেব্রা’, সুবিমল বসাক ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, অরুণেশ ঘোষ ‘জিরাফ’, দেবী রায় ‘চিহ্ণ’, ত্রিদিব ও আলো মিত্র ‘উন্মার্গ’ আর The Waste Paper, প্রদীপ চৌধুরী ‘ফুঃ’, শৈলেশ্বর ঘোষ ‘ক্ষুধার্ত’, সুভাষ ঘোষ ‘ক্ষুধার্ত খবর’ এবং পরে অলোক গোস্বামী প্রকাশ করতেন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’। ফিল্মে কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকারীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে চরিত্রটাকে আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রমাণ করার জন্য ! এই ফিল্মের কারণে দর্শকদের কাছেও হাংরি আন্দোলন হয়ে উঠেছিল খিল্লি করার ব্যাপার । পরাবাস্তব আন্দোলন, ডাডা আন্দোলন, বিট আন্দোলন, র্যাঁবো-ভেরলেন নিয়ে যেসমস্ত ফিল্ম তৈরি হয়েছে তাতে তাঁদের খিল্লি করা হয়নি।
পাঁচ
একইভাবে, ৬ জুন ২০১৫ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায়, শৈলেন সরকার,পুরো বই না পড়েই, কী লিখবেন ভেবে নিয়ে লিখেছেন, “মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ সংক্রান্ত মামলায় সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা দেওয়া বা বিভিন্ন সঙ্গীর এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের সমাপ্তির ঘণ্টা বেজে গেছে বলে তাঁর মনে হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই তাঁর সঙ্গীরা আদালতে সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেতে সুবিধাবাদের প্রশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু তিনিও কি নেননি? তিনি জানতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ কবিতাটিকে পছন্দ করেননি এবং সব জেনেও কেন মলয়বাবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যে করে তাঁর খারাপ লাগা কবিতাটিকে বিচারকের সামনে ভাল বলে শংসাদানে অনুরোধ করেছিলেন? যে অনুরোধ সুনীল রেখেওছিলেন। নিজে বাঁচার জন্য বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে অন্যকে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বলাটা কি কম সুবিধাবাদ? আর একটা কথা, ‘হাংরি প্রতিসন্দর্ভ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইওরোপীয় অধিবিদ্যাগত মনন বিশ্বের ফসল।’ তাঁর মনে পড়েছে মঙ্গলকাব্যগুলির কথা, তিনি লক্ষ্য করতে বলেছেন, ‘প্রাক ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই মাইক্রোপরিসরগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর রচয়িতারা নন।’ ওই একই লেখায় হাংরি আন্দোলনের শুরুর দিকে ফালি কাগজে প্রকাশিত রচনা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘রচনাগুলি দিলদরাজে বিলি করে দেয়া হত, যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাক-ঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতা বোধের গর্ব।’ কিন্তু প্রথম লিফলেটে হাংরি আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটর’ হিসাবে নিজের নাম ‘মলয় রায়চৌধুরী’ ছাপিয়ে মলয়বাবু নিজে কি ভারতীয় নশ্বরতাবোধের উদাহরণ রাখতে পেরেছিলেন?”
কবিতাটার শিরোনাম যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, শৈলেন সরকার খিল্লি করে তা পালটে দিয়েছেন । দ্বিতীয়ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাক্ষ্য দেবার আগে কবিতাটি পড়েননি । প্রথম পড়েন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে । সাক্ষ্য দেবার দুই বছর আগে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ প্রকাশ করেছিলেন । তৃতীয়ত, লিফলেটে ‘ক্রিয়েটর’ লেখা মানেই তা অশোকের শিলালিপি নয়, তা, পুলিশ কমিশনার যেমন বলেছিলেন, দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপন আর লোকে হাতে পেয়ে মুচড়ে বা ছিঁড়ে ফেলে দেবে । হাংরি আন্দোলনের শতাধিক লিফলেট প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু মাত্র কয়েকটিই পাওয়া যায়, কেননা তা ক্রিয়েটরের শিলালিপি ছিল না । আন্দোলনের সমাপ্তির কথা প্রদীপ চৌধুরীও ঘোষণা করেছিলেন, লাল কালিতে পুস্তিকা ছাপিয়ে, কিন্তু তা শৈলেন সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল । প্রদীপ তাঁর ব্যাখ্যায় জানিয়েছিলেন যে হাংরি আন্দোলন হয়ে উঠছিল একটি প্রতিষ্ঠান এবং তার মৃত্যু ঘোষণা জরুরি ছিল । প্রসঙ্গত, প্রদীপ চৌধুরী হাংরি আন্দোলনকে ত্রিপুরার কবি অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সেলিম মুস্তফা, অরূপ দত্ত প্রমুখকে নিয়ে আগরতলায় আরম্ভ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক কারণে অরুণ বণিক খুন হয়ে যাবার পর তা থেমে যায় । অরুণ বণিকের কবিতা আলোচিত হয় না । পরাবাস্তববাদীদের সমস্তকিছু কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে, করেছেন পরবর্তী প্রজন্ম।
অর্ক দেব হাংরি লেখক-কবিদের বইপত্র না পড়েই খিল্লি করেছেন, “হাংরি ধারণাটা লেখাজীবীর প্রেরণা। প্রেরণাই হতে পারে বড়জোর। আন্দোলন না বাল।”
স্নেহাশীষ রায় কোনও বইপত্রের প্রসঙ্গ ও আলোচনা ছাড়াই খিল্লি করেছেন, “মলয় রায়চৌধুরীর আত্মপ্রচারসর্বস্বতা, চালাকি, মিথ্যাচার ও ভন্ডামীর কারণে কিছুটা হলে হাংরি জেনারেশন তথা বাংলা কবিতার অন্যতম মেরুদন্ড শৈলেশ্বর ঘোষ তুলনামূলক অনেকটাই কম পঠিত ও পরিচিত৷যদিও এর কারণ কবির আত্মপ্রচারবিমুখতা, খ্যাতি, পুরস্কারকে সন্দেহ ও ঘৃণা করাও কিছুটা হতে পারে৷মহৎ কবির বৈশিষ্ট্য আর কী৷বাংলা কবিতার ভাষাবিমোচনকারী মৌলিক স্বরের এই কবি প্রতিষ্ঠান বা ‘ক্ষমতার ভাষা’কে পরিহার করে নিজনির্মিত স্বতন্ত্র ভাষায় আজীবন কবিতা,গদ্য,নাটক রচনা করে গেছেন৷তাঁর রচনা প্রতি মুহূর্তে আমাদের বিবেকের সামনে দাঁড় করায়,আমাদের সামাজিক মুখোসগুলো খসে পড়ে তাঁর কবিতার মুখোমুখি হলে৷আজীবন যে কবিকে মার্জিনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় ক্রমশ,যখন তাঁর বেশকিছু পাঠক হয়,তাঁকে আর কিছুতেই অস্বীকার করা যায়না,তখন সেই প্রতিষ্ঠানই আবার তাঁকে নিয়ে ব্যবসা করে৷মুনাফালোভী নগ্নতার এই তো চরিত্র !আজ এই অস্থির সমাজে, বন্ধা সময়কালে শৈলেশ্বরের রচনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷”
শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মলয় রায়চৌধুরীকে উল্লেখ করতে হল কেন ? খিল্লি করার সদ্ব্যবহার করার জন্য । শৈলেশ্বর ঘোষের অনুগামীরা যে সুভাষ ঘোষকে মারধর করেছিল, তা স্নেহাশীষ রায় উল্লেখ করলেন না। করলে কোনও ক্ষতি হতো না, কেননা মারধরের ব্যাপার পরাবাস্তববাদীদের মধ্যেও হতো ।
ছয়
হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখা বইপত্র না পড়েই অনেক আলোচককে এই “মৃত্যুঘণ্টা” শব্দটা ব্যবহার করতে দেখা গেছে — একথা আমাকে জানিয়েছেন বিষ্ণুচন্দ্র দে, যিনি আমার লেখালিখি নিয়ে পিএইচডি করেছেন। মৃত্যু হলে গির্জার ঘণ্টা বাজায় খ্রিস্টানরা, হিন্দু-মুসলমানরা নয় । উদয়শংকর বর্মা হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচডি করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । গৌতম চক্রবর্তী বহু বিদেশি নাম বাদ দিয়ে দিয়েছেন ; সম্ভবত তিনিও লেখার আগেই হাংরি আন্দোলনকারীদের খিল্লি করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা জানতো যে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স মর্গে যেতে ভালোবাসতেন; সেখানে দিনের একটা সময় কাটাতেন। মর্গে যাওয়া ছাড়াও চার্লস ডিকেন্সের ছিল আফিমে আসক্তি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছিল মদের প্রতি আসক্তি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদারের মতন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফরাসি ও স্কচ খেতে পছন্দ করতেন । নীলাঞ্জন হাজরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় প্রচুর মদ খেতেন, কেউ-কেউ বাংলা মদ ; একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় মহুয়ার মদ খেয়ে তাঁর বুকে বসে গলা টিপে ধরেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের নেশা করাকে যেভাবে খিল্লি করা হয়, এনাদের ও বিদেশিদের নেশা করাকে এড়িয়ে যাওয়া হয় ।
মদের ভালোবাসা থেকে হেমিংওয়ে লিখেছেন- যখন আপনি মাতাল, তখন আপনি অনেক বেশি ভদ্র । এটা আপনার মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করবে। আমেরিকান রোমান্টিক মুভমেন্টের প্রধান ব্যক্তি, এডগার অ্যালান পো ছিলেন মাদকাসক্ত। হেমিংওয়ের মতো তিনিও দুঃখ থেকে মুক্ত থাকার জন্য মদ খাওয়া আরম্ভ করেন । কলকাতার খালাসিটোলায় আর বারদুয়ারিতে বহু মাতালকে দুঃখে কাঁদতে দেখা গেছে – সুতরাং মদ খাওয়াকে বা নেশা করাকে খিল্লি করে উড়িয়ে দেয়া যায় না । ব্রিটিশ কবি, রোমান্টিক মুভমেন্টের অন্যতম প্রবক্তা, ‘কুবলা খান’ও ‘দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’ এর কবি স্যমুয়েল টেইলর কোলরিজ আফিমে আসক্ত ছিলেন। সেই সময় তিনি আফিমখোর হিসেবে ব্রিটেনে পরিচিত ছিলেন এবং এটা নিয়ে তিনি গর্বও বোধ করতেন। তিনি বলেছেন, কুবলা খান লিখতে গিয়ে আফিমের ঘোর তাঁকে সাহায্য করেছিল। ট্রেজার আইল্যান্ড, দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইড-এর স্রষ্টা স্কটিশ সাহিত্যিক রবার্ট লুই স্টিভেনসন ছিলেন কোকেনে আসক্ত। তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, তিনি কোকেন নিয়ে মাত্র ছয় দিনে ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় ৬০ হাজার শব্দ লিখেছিলেন। এর মধ্যে দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইডও লিখেছেন।
শার্ল বোদলেয়ার হ্যাশিসের নেশা করতেন এবং তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘নকল স্বর্গ : আফিম ও চরস’ রচনায় তা লিখে গেছেন । মমার্ততে পিকাসোর স্টুডিওতে ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত আফিমের সান্ধ্য আড্ডা বসতো ; নেশা করে মাদুরে শুয়ে থাকতেন তাঁরা, একটিমাত্র কুপি জ্বালিয়ে, যাতে অন্ধকারে নেশার মৌতাত নেয়া যায় । বিশ শতকের ফরাসি আভাঁ গার্দের অনেকে সেখানে একত্রিত হতেন, যেমন আমেদেও মদিগলিয়ানি, হুয়ান গ্রিস, পাবলো গারগালো, আঁদ্রে সালমঁ, গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার, ম্যাক্স জেকব প্রমুখ । গেয়র্গে ব্রাকের প্রেমিকা পলেতে ফিলিপির আফিম চাটা আর ফোঁকার দোকান ছিল মুলাঁ রুজের পেছনে । আরেকটি ছিল ডক্টর পল আলেকজান্দ্রের, যিনি বিশ্বাস করতেন যে কল্পনার বিস্তার ঘটাতে আফিম আর চরসের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না ; আফিম আর চরসের নেশা মানুষকে সময়ের পরিসর থেকে বিচ্যূত করে । পিকাসোকে নেশা ধরিয়েছিলেন গেয়র্গে পিগা, আর এই নেশা থেকেই পিকাসোর নীল পর্বের আরম্ভ । তিনি তাঁর পেইনটিঙের পরিসরের মাত্রায় সময়কে আনতে চাইছিলেন, যে শৈলীকে আলোচকরা নাম দেন ‘কিউবিজম’। পিকাসো বলেছেন যে চাকা আবিষ্কারের পর মানুষের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল আফিম । জাঁ ককতোকে তিনি বলেছিলেন যে আফিম মানুষকে বদান্য করে তোলে, তাকে লোভ থেকে মুক্তি দেয় ।
পিকাসো ১৯০৮ সালে আফিমের আড্ডা ভেঙে দেবার পর পরাবাস্তববাদী চিত্রকর আঁদ্রে ম্যাসনের স্টুডিওতে সবাই জড়ো হতেন । স্বতঃউৎসারিত বা অটোম্যাটিক লেখা ও আঁকার পরাবাস্তববাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো আঁদ্রে ম্যাসনের স্টুডিওতে, এবং তা আফিমের নেশা করে ম্যানদারিন কিউরাকাও পান করার পর । অতিথিদের মধ্যে নিয়মিত আসতেন হেমিংওয়ে, গারট্রুড স্টিন, ম্যাক্স আর্নেস্ট, মান রে এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ । ১৯২৪ সালে ২৪ বছর বয়শে অত্যধিক আফিম নেবার ফলে তাঁর বন্ধু জাক ভাশের মৃত্যুর পর আঁদ্রে ব্রেতঁ মাদকবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং যে পরাবাস্তববাদীরা মাদক নিতেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে । তাছাড়া পরাবাস্তব আন্দোলন আরম্ভ করার আগে ব্রেতঁ, লুই আরাগঁ ডাকতারি পড়েছিলেন । মাদকনির্ভর স্বয়ংক্রিয় লেখা ও আঁকার বিরোধী ছিলেন এনারা এবং বিশ্বাস করতেন ফ্রয়েডিয় তত্বে । ব্রেতঁর এই ভাবনায় বিশ্বাস করতেন না বেশ কয়েকজন পরাবাস্তববাদী, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অঁতনা আর্তো, যিনি ছিলেন আফিম ও চরস সেবন করে ইন্দ্রিয়কে বিপর্যস্ত করার ভাবনায় বিশ্বাসী । মাদক নিয়ে ইন্দ্রিয়কে বিপর্যস্ত করার আরেক সমর্থক ছিলেন কবি, ফিল্মনির্মাতা ও চিত্রকর জাঁ ককতো, যিনি বলতেন যে আফিমের আহ্লাদ হল স্বাস্হ্যের চেয়ে উন্নত, এবং অত্যধিক সেবনের কারণে প্রায়ই তাঁকে স্যানাটোরিয়ায় ভর্তি করা হতো আর সেরে ওঠার পর আবার নেয়া আরম্ভ করতেন ।
সাত
হ্যাঁ, হাংরি আন্দোলনকারীরা অভিজ্ঞতার জন্য মাদকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন । ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাতে যেতে না হয় তাই মার্কিন যুবক-যুবতীরা হিপি হয়ে যাচ্ছিলেন এবং বিদেশে পাড়ি মারছিলেন, বিশেষ করে ভারতে ও নেপালে। হিপিরা বিটনিক নন । তাঁদের এই পলায়নের জীবনযাপনের খরচ যোগাতেন তাঁদের বাবা-মা, আমেরিকান এক্সপ্রেসের মাধ্যমে তাঁদের টাকা পাঠিয়ে । আমেরিকার চাপে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ভারতেও, মাদকবিরোধী আইন পাশ হয় আশির দশকে । ষাটের দশকে সরকারী দোকানে গাঁজা, আফিম, চরস পাওয়া যেতো, এখনকার মতন লুকোছাপার দরকার হতো না । খালাসিটোলার পাশেই ছিল একটা সরকারি দোকান, বেনারসেও বহু দোকান ছিল । নেপালে সর্বত্র পাওয়া যেতো। বেনারসে আর কাঠমাণ্ডুতে হিপি কলোনি গড়ে উঠেছিল । হাংরি আন্দোলনের চিত্রকর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাই-এর নাম হিপিদের কাছে লোকমুখে পৌঁছে গিয়েছিল আর তারা বেনারসে পৌঁছে, থাকা-খাওয়ার সুবিধার জন্য ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করত । করুণানিধান মুখোপাধ্যায় তো একসময়ে হিপি কলোনির রান্নার ইনচার্য হয়েছিল । আমরা এদের দুজনের সংস্পর্শে আসার পর বিভিন্ন মাদকের এবং হিপি জীবনযাত্রার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হই । আমি এই জীবনযাত্রার কিছুটা তুলে ধরেছি আমার উপন্যাস “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা”তে । করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের এই দুটো চিঠি থেকে কিছুটা ধারণা হবে :-
কাঠমাণ্ডু
১১ এপ্রিল ১৯৬৬
মলয়, হুররেরেরে
এই ঠিকানায় চিঠি দাও বা প্রভাতীর চিঠি এলে সেই চিঠিকে রিডাইরেক্ট না করে আর একটা খামের মধ্যে পুরে নতুন ভারতীয় স্ট্যাম্প লাগিয়ে পাঠাও ।
কী করে আসতে হবে চার্ট পাঠালাম ।
সমীরকে চিঠি দিয়েছি । অনিলকেও ।
কাল থেকে বেরিয়ে পড়ব বার্তা নিয়ে ।
এখানে সেই যে বালিশের নিচে মুড়ি দিয়ে র্যাঁবো পড়ে, সেই ঘি ( গাই )-এর সঙ্গে দেখা – ওর ওখানেই উপস্হিত ।
দারুণ ব্যাপার ।
তাড়াতাড়ি এসো ।
লুণ্ড হয়ে থাকা যাক কিছুদিন ।
অফুরন্ত চরস আর মেয়েছেলে ।
আন্ডারগ্রাউণ্ড আর ওভারগ্রাউন্ড মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন ছেলে আর মেয়ে — একেবারে গিজগিজ করছে । শিগগির এসো, আমি হাংরি হ্যাপেনিং করার তালে আছি । পরে মোটা খাম পাঠাচ্ছি ।
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়
প্রিয় মলয়,
হঠাৎ আফগানি মাল কিছুটা পেয়ে গেলাম বেশ খানিকটা । বিলি করা শুরু করেছি, তোমায় পাঠালাম, চাপ দিলেই গুঁড়ো, সিগারেট পাইপ ছিলিম যাতে খুশি খেতে পারো । মালের প্রাপ্তি সংবাদ দিও ।
হঠাৎ আমার এক অ্যালসেশিয়ান বন্ধুর সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলাম । সুবিমলের আস্তানায় ছিলাম । সুবিমল, সুভাষ, ফালগুনী, শম্ভু রক্ষিত, ত্রিদিব, আলো আর দেবীও পীড়াপীড়ি করে জুটেছিল খালাসিটোলায় । মাতাল অবস্হায় জেনারেশনের সবাই গড়াগড়ি দিয়েছিল, দেবী ছাড়া ।
আজকার ভীষণ একটা যা-তা, বিশ্রী, দারুণ গালাগালি দিয়ে নিজের নোংরামিগুলো বমি করতে ইচ্ছে করছে । লেখাটা সেই নিয়ে চলছে । আমি অনিল একটা পত্রিকা বের করার তালে আছি, তোমার কানে পৌঁছে থাকবে । ভালোবাসা—
করুণা
( তারিখ মনে নেই )
গাঁজা, আফিম, চরস সরকারি দোকানে পাওয়া গেলেও, এলএসডি পাওয়া যেতো হিপিদের কাছ থেকে। ওরা লাইসারজিক অ্যাসিডে ব্লটিঙপেপার ভিজিয়ে আনতো বা চব্বিশ ঘণ্টা, আটচল্লিশ ঘণ্টা, বাহাত্তর ঘণ্টার ট্রিপের ক্যাপসুল আনতো । কাস্টমসে কোনও নিষেধ ছিল না । জাঁ ককতো আর পিকাসো মাদকের যে আহ্লাদের কথা বলেছেন তা পাওয়া যেতো এইগুলো আলাদা বা একসঙ্গে নিয়ে, পাইপে বা সেই সময়ের চারমিনার সিগারেটে পুরে । ফালগুনী রায় আর শৈলেশ্বর ঘোষ গাঁজা ফুঁকতে ভালোবাসতেন । ফালগুনীর চরসের মেঠাই আর ভাঙের শরবত ভালো লাগতো । বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, অবনী ধর, সুবিমল বসাক, প্রদীপ চৌধুরী ভালোবাসতেন মদ খেতে । অনুকুল ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নেবার পর সুবো আচার্য মাদক নেয়া ছেড়ে দেন । নিজে ঋত্বিক হবার পর মাদক আর সমকামের ব্যাপারে তিনি নিয়মিত বক্তৃতাও দেন তাঁর শিষ্যদের । সরকারি অধিকারী হবার পর ত্রিদিব মিত্রও ছেড়ে দেন মাদক নেয়া । কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের মাদক নেয়া নিয়ে খিল্লি করা হয় কেন তা বোধগম্য নয়, যখন কিনা বর্তমানে বহু কলেজ ছাত্রীও পাতা ফোঁকেন ।
আট
১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে তাঁর সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশিল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। ইউরোপিয় ধ্রুপদি সাহিত্যের নান্দনিক শুদ্ধাচারের বাঁধন ছিঁড়ে বেরোবার পথ খুঁজছিলেন ব্রেতঁ। একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি আমি পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য যেভাবে আমার খিল্লি করা হয়, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । আমি হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করি ১৯৬১ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে । পত্রিকার পরিবর্তে লিফলেট প্রকাশ করা নিয়েও খিল্লি হয় ।
যাঁরা কবি ও লেখকদের পারস্পরিক অবনিবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁরা হাংরিদের লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণের ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখেননি, বিশেষ করে কৌম-সমাজটির আর্থসামাজিক পৃষ্ঠপটে ও পূর্বের সাহিত্যিক পঠন-পাঠনের প্রভাবে নির্মিত তাঁদের প্রতিস্ব ।
প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ও প্রথম ছোটোগল্পকার পূর্ণচন্দ্র থেকে হাল আমলের মফসসলের কথাসাহিত্যিক, প্রান্তিক ও শহুরে গল্পকার কিংবা মেট্রপলিটান ঔপন্যাসিক, তাঁদের লেখক প্রতিস্ব অবিনির্মাণ করলে প্রথম যে উপাদানটি পাওয়া যাবে, তা তাঁদের মাতৃভাষায় এবং অন্যান্য যে ভাষায় তাঁদের দখল আছে, সে ভাষায় পূর্ব প্রজন্মগুলোর সাহত্যিকদের লেখা গল্প-উপন্যাসের পঠন-পাঠনের জমা করা স্মৃতি । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণে ভাষাসাহিত্যের জ্ঞান তথা সাহিত্যের বিশেষ ঝোঁকের প্রতি লেখকের টান, তাঁর লেখনকর্মের আদল আদরা দিশা তাৎপর্য অন্তর্নিহিত-সম্পদ দাপট চৈতন্য অস্তিত্ব আত্ম-উন্মোচন এমনকী তাঁর সাহিত্য চক্রান্তক কলমটির গঠনকারী মূল উপাদান । তাঁদের লেখন-অভিজ্ঞতার মালিকানার বখরা কিন্তু তাঁদের পড়া পূর্বসূরী গল্পকার-ঔপন্যাসিক-দার্শনিকদের প্রাপ্য।
আমি যে প্রতিস্ব-নির্মাণের কথা বলছি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ বাঁকবদলের সময়কার । উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা, কথামঞ্জরী, দশকুমার চরিত, বাদবদত্তা ইত্যাদি গদ্যে রচিত কথাবস্তুর অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ইংরেজরা আসার পর, এবং ফলে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও গদ্যে নানা ধরণের সংরূপের উদ্ভব জলবিভাজকের কাজ করেছিল ; আমি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি । এক নতুন নন্দনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সাহিত্যের এলাকায়, যে এলাকায় লেখক নামের নির্মিত-প্রতিস্বের মানুষটির লেখনকর্মকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে নৈতিকতা আর বৈধতা আরোপের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল । ফলে লেখনকর্ম বা পাঠবস্তুতে সতত কেন্দ্র দখল করে থাকলেন লেখ-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমালিকটি ।
ইংরেজরা আসার পরই, আর বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত-প্রতিস্ব নিয়ে লেখন-পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেখন পরিসরে ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি-আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তিপ্রসূত রচনাগত মৌলিকতা, ব্যক্তিসৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো হিন্দু বাঙালির জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিল সেই সময়কার কলকাতায় ইউরোপিয় আলোকপ্রাপ্তির মননবিশ্বটি পাকাপাকি ভাবে থিতু হয়ে বসার পর । ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি, তারপর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ওই মননবিশ্ব প্রবেশ করতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মননবিশ্বটি ওই আদরায় নির্মিত হবার পর এবং ফলে, আর একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সালে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতী’ । তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ আর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠবস্তুগুলোতে ওই মননবিশ্বের ছাপ ছিল না ।
পূর্ণচন্দ্র তাঁর গল্পটিতে নামস্বাক্ষর করেননি । ‘নববাবুবিলাস’ আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছদ্মনামে লেখা । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা ছোটোগল্প — সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বইতে জানিয়েছেন যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে ( ১২৮০ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একশ ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোয় লেখকরা নামস্বাক্ষর করেননি, এমনকী ছদ্মনামও নয় । রচনার সঙ্গে লেখকের নাম দেওয়ার প্রথাটি প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবশালী প্রতিনিধি । সেসময়ে ব্রা্হ্মধর্ম হয়ে উঠেছিল ওই মননবিশ্বের ধারক ও বাহক । নামস্বাক্ষর না-করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট যে কথাবস্তুর রচয়িতারা জানতেন না যে লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, এবং লেখকের নামটি সত্তাটিকে বহন করে । কোনও কথাবস্তু যে মেধাস্বত্ত, সে ধারণাটির প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছিল । তার কারণ অস্তিত্বের কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষকে স্হাপনের কর্মকাণ্ডটির প্রভাব, যাকে উনিশ শতকের রেনেসঁস বলা হয়, সেই চিন্তাচেতনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য অজস্র নির্মিত-প্রতিস্বের প্রয়োজন ছিল । ইউরোপীয় চিন্তনতন্ত্রটির বাইরে যে নন্দনক্ষেত্রটি রয়ে গেল, জলবিভাজিকার অন্য দিকে, তাকে বটতলা নামে এইজন্য দোষারোপ করা হল যে সেই এলাকায় ব্যক্তিএককগুলো অনির্মিত। জেমস লঙ বললেন বটতলার বইগুলো অশ্লীল ও অশোভন, যার দরুন বাংলার সংস্কৃতি থেকে লোপাট হয়ে গেল বইগুলো । একইভাবে, জেমস লঙের বাঙালি বংশধররা হাংরি আন্দোলনের কাজগুলোকে বলেন অশ্লীল ও অশোভন ।
ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । এই কারণেই হাংরি আন্দোলনকে বুঝতে পারেন না অনেকে, হাংরিদের কবিতা ও গদ্যকে পূর্বের কবি ও লেখকদের কাজের পাশে রেখে তুলনা করতে চান । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না । হাংরি আন্দোলনকারীদের, ডাডাবাদীদের মতনই, এই প্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে ।
বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন আলোচককে মন্তব্য করতে দেখা গেছে যে, উপন্যাস আর্ট ফর্মটির বঙ্গীয়করণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, ছোটোগল্প আর্টফর্মটিকে সম্পূর্ণ দেশজ করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সনেট-তের্জারিমা-ভিলানেলকে এতদ্দেশীয় করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, ইত্যাদি । এই যে একটি ভিন্ন ভাষসাহিত্যের সংরূপকে আরেকটি ভাষাসাহিত্যে এনে সংস্হাপন, এর জন্য দ্বিভাষী দক্ষতা এবং সংরূপটি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানই যথেষ্ট নয় । যিনি এই কাজটিতে লিপ্ত, তাঁর গ্রাহীক্ষমতা, বহনক্ষমতা ও প্রতিস্হাপন ক্ষমতা থাকা দরকার। অমন ক্ষমতা গড়ে ওঠে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে । আর এই জ্ঞান আহরণ তখনই সম্ভব যখন আ্হরণকারীর লেখক-প্রতিস্বের নির্মাণ ঘটে জ্ঞানটির পরিমণ্ডলে । সার্থকতা নামের মানদন্ডটি ওই চিন্তনতন্ত্রের ফসল । বর্তমান কালখণ্ডে ওই চিন্তনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ ।
নয়
আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ সালে পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছুকাল পরে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণে তাঁর সঙ্গে লুই আরাগঁর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল । মার্সেল দ্যুশঁ, ত্রিস্তঁ জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ, উভয়ের সঙ্গেই ছিলেন, এবং দুটি দলই তাঁকে গুরুত্ব দিতেন, দ্যুশঁ’র অবাস্তব ও অচিন্ত্যনীয় ভাবনার দরুন। এই দলবাজিকে কিন্তু মৃত্যুঘণ্টা নামে কেউ খিল্লি করেননি ।
পরাবাস্তব আন্দোলনের আগে জুরিখে ডাডাবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদের অনুপ্রেরণা পান ডাডা আন্দোলনের পুরোধা ত্রিস্তঁ জারার কাছ থেকে, কিন্তু ব্রেতঁ চিরকাল তা অস্বীকার করে্ছেন । ডাডা ছিল শিল্পবিরোধী আভাঁ গার্দ আন্দোলন ; অবশ্য প্রতিশিল্পও তো নির্মাণ । ডাডাবাদের রমরমার কারণে ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ব্রেতঁর সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায় ; একজন অন্যজনের নেতৃত্ব স্বীকার করতে চাইতেন না । ডাডা (/ˈdɑːdɑː/) বা ডাডাবাদ (দাদাবাদ নামেও পরিচিত) ছিল ২০ শতকের ইউরোপীয় ভিন্নচিন্তকদের একটি সাহিত্য-শিল্প আন্দোলন, যার প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার ( ১৯১৬ নাগাদ ) এবং নিউ ইয়র্কে (প্রায় ১৯১৫ নাগাদ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির কাজ প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্যতে। ডাডাবাদীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। ব্রেতঁ মনে করতেন ডাডাবাদীরা নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কিস্ট, যখন কিনা তিনি একজন কমিউনিস্ট ।
পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে যাঁরা ব্রেতঁর সঙ্গে একে-একে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন ফিলিপে সুপো, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, রেনে ক্রেভাল, মিশেল লেইরিস, বেনিয়ামিন পেরে, অন্তনাঁ আতো,জাক রিগো, রবের দেসনস, ম্যাক্স আর্নস্ত প্রমুখ । এঁদের অনেকে ডাডাবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দেন। তখনকার আলোচকরা বলেননি যে ডাডাবাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেল । পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে ১৯২৩ সালে যোগ দেন চিত্রকর আঁদ্রে মাসোঁ ও ইভস তাঙ্গুই । ১৯২১ সালে ভিয়েনায় গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেতঁ । ফ্রয়েডের ধারণাকে তিনি সাহিত্য ও ছবি আঁকায় নিয়ে আসতে চান । ফ্রয়েডের প্রভাবে ব্রেতঁ বললেন, সুররিয়ালিজমের মূলকথা হল অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ডাডাবাদীরা চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীর থেকে তুলে আনা।
পরাবাস্তববাদের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইশতাহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে অনুমান করে, এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আঁদ্রে ব্রেতঁ দ্বিতীয় ইশতাহারটি প্রকাশ করেন এবং ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতাহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ—দুজনে দু দল পরাবাস্তববাদীর নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের দলে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তঁ জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতঁর দলে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ায়, রোবের ডেসনোস, জ্যাক বারোঁ, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডা আন্দোলনের কয়েকজন সদস্য ছিলেন। ইয়ান গল আর আঁদ্রে ব্রেতঁ আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্য তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই পরাবাস্তববাদীরা ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে থাকেন, যদিও তাঁদের ভাবনাচিন্তা ও সাহিত্যধারা ছিল একই । তা সত্বেও আলোচকরা আন্দোলনের মৃত্যুঘণ্টা বাজার কথা বলেননি । পরে আন্দোলনে যোগ দেন জোয়ান মিরো, রেমণ্ড কোয়েনু, ম্যাক্স মোরিজ, পিয়ের নাভিল, জাক আঁদ্রে বোইফার, গেয়র্গে মালকাইন প্রমুখ ।
পরাবাস্তববাদকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। হাংরি আন্দোলনকেও নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায় না । হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রতিস্ব তো একক, নিটোল, একশিলা, একমুখি নয়। পরাবাস্তববাদীরা একই আন্দোলনের সদস্য হয়ে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে ব্যক্তিগত পার্থক্য ছিল। মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে নিজস্ব ভাবনা ভেবেছেন, যে কথা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না। সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’
তাঁদের রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে, এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । তবুও তাকে আন্দোলনের মৃত্যুঘণ্টা বলে খিল্লি করা হয়নি । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েল, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু পরাবাস্তব গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে লোরকার মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করেছে ; সেই থেকে আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন , যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন ।
১৯৩০ সালে কয়েকজন পরাবাস্তববাদী আঁদ্রে ব্রেতঁ’র একচেটিয়া নেতৃত্বে বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি প্যামফ্লেট ছাপিয়েছিলেন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আবার আরেক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায় । ১৯৩৫ সালে ব্রেতঁ এবং সোভিয়েত লেখক ও সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবার্গের মাঝে ঝগড়া এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় যে প্যারিসের রাস্তায় তাঁদের দুজনের মারামারি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । এরেনবার্গ একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীরা পায়ুকামী । সালভাদর দালি বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে প্রকৃত সাম্যবাদী হলেন একমাত্র রেনে ক্রেভাল । চটে গিয়ে ক্রেভালকে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ । অঁতনা অতো, ভিত্রাক এবং সুপোকে পরাবাস্তববাদী দল থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ, মূলত সাম্যবাদের প্রতি ব্রেতঁর আত্মসমর্পণের কারণে এই তিনজন বিরক্ত বোধ করতেন । স্তালিনপন্হী আরাগঁ ও ট্রটস্কিপন্হী ব্রেতঁর কখনও মিটমাট হয়নি । কাট-আপ কবিতার জনক ব্রায়ন জিসিনকেও গোষ্ঠী থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ ; ব্রায়ান জিসিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ । বিট আন্দোলনের প্রায় সকলেই পরাবাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বিটদের যৌন স্বাধীনতার ভাবনা-চিন্তায় সুররিয়ালিস্টদের অবদান আছে । হাংরি আন্দোলনকারীরা কেউই কিন্তু কাউকে বের করে দিতেন না, কেননা অমন ক্ষমতা কারোরই ছিল না ।
দশ
পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে বহু মহিলা সদস্য ছিলেন । কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখ্য ফ্রিদা কাহলো, আসে বার্গ, লিজে দেহামে, আইরিন হামোয়ের, জয়েস মানসোর, ওলগা ওরোজকো, আলেহান্দ্রা পিৎসারনিক, ভ্যালেনটিন পেনরোজ, জিসেল প্রাসিনস, ব্লাঙ্কা ভারেলা, ইউনিকা জুর্ন প্রমুখ । নারী চিত্রকররা সংখ্যায় ছিলেন বেশি । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য গেরট্রুড আবেরকমবি, মারিয়ন আদনামস, আইলিন ফরেসটার আগার, রাশেল বায়েস, ফ্যানি ব্রেনান, এমি ব্রিজওয়াটার, লেনোরা ক্যারিংটন, ইথেল কলকুহুন, লেনোর ফিনি, জেন গ্রাভেরোল, ভ্যালেনটিন য়োগো, ফ্রিদা খাহলো, রিটা কার্ন-লারসেন, গ্রেটা নুটসন ( ত্রিস্তঁ জারার স্ত্রী ), জাকেলিন লামবা ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র স্ত্রী), মারুহা মালো, মার্গারেট মডলিন, গ্রেস পেইলথর্প, অ্যালিস রাহোন, এডিথ রিমিঙটন, পেনিলোপি রোজমন্ট, কে সেজ ( ইভস তাঙ্গুইর স্ত্রী ), ইভা স্বাঙ্কমাজেরোভা, ডরোথি ট্যানিঙ ( ম্যাক্স আর্নস্টের স্ত্রী ), রেমেদিওস ভারো ( বেনিয়ামিন পেরের স্ত্রী ) প্রমুখ । ভাস্করদের মধ্যে উল্লেখ্য এলিজা ব্রেতঁ ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র তৃতীয় স্ত্রী ), মেরে ওপেনহাইম ( মান রে’র মডেল ছিলেন ) এবং মিমি পারেন্ট । ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ক্লদ কাহুন, নুশ এলুয়ার, হেনরিয়েতা গ্রিনদাত, আইডা কার, দোরা মার ( পাবলো পিকাসোর সঙ্গে নয় বছর লিভ টুগেদার করেছিলেন ), এমিলা মেদকোভা, লি মিলার, কাতি হোরনা প্রমুখ । পুরুষ পরাবাস্তববাদীদের বহু ফোটো এই নারী ফোটোগ্রাফারদের কারণেই ইতিহাসে জায়গা পেয়েছে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে ১৯৩৯ সালে অধিকাংশ পরাবাস্তববাদী বিদেশে পালিয়ে যান এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিয়ে তর্কাতর্কি বেধে যায় । অলোচকরা মনে করেন যে গোষ্ঠী হিসাবে ১৯৪৭ সালে পরাবাস্তববাদের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু ভাবনা হিসেবে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে , প্যারিসে “লে সুররিয়ালিজমে” প্রদর্শনীর পর । যুদ্ধের শেষে, প্যারিসে ব্রেতঁ ও মার্সেল দ্যুশঁ’র ফিরে আসার পর প্রদর্শনীর কর্তারা সম্বর্ধনা দিতে চাইছিলেন কিন্তু পুরোনো পরাবাস্তববাদীরা জানতে পারলেন যে একদল যুবক পরাবাস্তববাদীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশ ভিন্ন পথ ধরে এগোতে চাইছেন । যুবকদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ফ্রাঁসিস বেকঁ, আলান দাভি, এদুয়ার্দো পোলোৎসি, রিচার্ড হ্যামিলটন প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে মৃত্যুর আগে, ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “ডাডা আন্দোলনের পর আমরা মৌলিক কিছু করিনি” । এই দুটি আন্দোলন অংশগ্রহণকারীদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং কয়েকজন আত্মহত্যা করেছিলেন, যেমন জাক রিগো, রেনে ক্রেভেল, আরশাইল গোর্কি, অসকার দোমিংগেজ প্রমুখ । অত্যধিক মাদক সেবনে মৃত্যু হয় গিলবার্ত লেকঁতে ও অঁতনা আতোর ।
‘আয়নানগর’ পত্রিকার অক্টোবর ২০১৬ সংখ্যায় নন্দিনী ধর লিখেছেন: “বহু ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি পেয়েছি একটি নারী নাম— আলো মিত্র। হাংরি দলিল-দস্তাবেজে তিনি ত্রিদিব মিত্রের স্ত্রী বলে চিহ্নিত। এই বিপুল পিতৃতান্ত্রিক নির্ভরতার সূচক ছাড়া, তাঁর অন্য কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না অন্য কোনো লেখা। কোনো পাঠক যদি অন্য কোনো ইতিহাসের হদিশ দিতে পারেন আমায়, দিতে পারেন অন্য কোনো তথ্য, বাধিত হব। বদলে নেব নিজের ভাবনাচিন্তার গতিপথও। পরবর্তী সময়ে সুনীতা ঘোষ নামে এক কবির কবিতা পাওয়া যায় দু-একটি সংকলনে।” ষাটের দশকে দুজন মহিলা যে হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার দাপট দেখিয়েছিলেন, সেটাই তো যথেষ্ট, নয় কি ? এখন ওনারা নন্দিনী ধরের ঠাকুমা-দিদিমার চেয়েও বয়সে বড়ো । খিল্লি করার আগে নন্দিনী ধর তাঁর ঠাকুমা-দিদিমার বয়সী কবিদের জিগ্যেস করলেই পারতেন যে হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার মতন সৎসাহস কারোর ছিল কিনা ! আলো মিত্র ছিলেন আন্দোলনের দুটি পত্রিকার সম্পাদক :’উন্মার্গ’ ও The Waste Paper ; আর দুটি চিঠি সংকলনের সম্পাদক । নন্দিনী ধর যে কী ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন তা তিনিই জানেন । একবার সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে গেলেই পারতেন কিংবা ইতালিয় হাংরি-গবেষক দানিয়েলা লিমোনেলার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন।
No comments:
Post a Comment